ডিসেম্বরে চালু হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল
রাজধানীর যানজট নিরসন এবং স্বস্তিদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে মেট্রোরেলের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আগামী আটমাসের মধ্যে মেট্রোরেলে চড়ে রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যেতে পারবেন নগরবাসী। আর মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেনে চলাচল করতে অপেক্ষা করতে হবে আরো এক বছর। অর্থাৎ, ২০২০ সালের মধ্যে রাজধানীবাসী পুরোদমে মেট্রোরেলে যাতায়াতের সুবিধা পাবেন। এতে করে নিত্যদিনের যানজটের ভোগান্তি থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলবে রাজধানীবাসীর।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। চলমান এ কাজের কারণে রাজধানীতে যানজট বেড়ে গেছে। রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় অনেক বাসের রুটও পরিবর্তন করা হয়েছে। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগামীতেও আরো কিছু রুটে বাস চলাচলে পরিবর্তন আনা হবে বলে জানা গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নির্মাণ কাজের কারণে কিছুটা জনদুর্ভোগ হলেও তা সাময়িক। প্রকল্পের কাজ যত দ্রæত শেষ হবে ততই দুর্ভোগ কমে আসবে।
২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিশেষ উদ্যোগে সংশোধিত পরিকল্পনা নেয়া হয়। উত্তরা-মতিঝিল রুটে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এরমধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত একটি অংশ। অপর অংশটি হচ্ছে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত।
চলতি বছরের জুনে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আর চালু হওয়ার কথা রয়েছে ডিসেম্বরে। অন্যদিকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, উত্তরা-আগারগাঁও অংশের কাজ শেষ হয়েছে ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের কাজ শেষ হয়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের প্রকল্প ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ ২১ হাজার টাকা। এরমধ্যে জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার যোগান দিচ্ছে সরকার। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ মোট আটটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের ডিপোর মাটি উন্নয়ন ও ডিপো নির্মাণ অন্তুর্ভুক্ত রয়েছে ১ ও ২ নং প্যাকেজে। উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়ালপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে প্যাকেজ ৩ ও ৪ নং এর আওতায়।
প্যাকেজ ৫ ও ৬ নং এর আওতায় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল ভায়াডক্ট ও স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। প্যাকেজ সাতের আওতায় মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোয় ওঠানামার জন্য চলন্ত সিঁড়ি ও লিফট, প্রায় ২০ কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক, স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায় ব্যবস্থাপনা, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, টেলিকমিউনেশন সিস্টেম, প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর ইত্যাদি স্থাপন করা হবে। সর্বশেষ প্যাকেজ ৮ এর অধীনে মেট্রোরেলের জন্য রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হবে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্তু মেট্রোরেল হবে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ। থাকবে ১৬টি স্টেশন। প্রতি চার মিনিট পরপর এক হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল। প্রতি ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহন করবে প্রায় ৬০ হাজার। ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। মেট্রোরেল চালু হলে সড়ক পথে কমে যাবে যানযট। এর ফলে প্রতিদিন কয়েক লাখ যাত্রী এই রুটে স্বস্থিদায়ক চলাচল করতে পারবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) খান মো. মিজানুল ইসলাম ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, লক্ষ্য পূরণে নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উড়াল সড়কের চাইতে মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্পের বেশি সুফল পাবেন সাধারণ মানুষ। তাছাড়া যানজট এড়াতে মেট্রোরেলের কোন বিকল্প নেই। এই প্রকল্পটিই হবে যানজট নিরসনে সবচেয়ে কার্যকর। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজধানীর যানজটের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) অনুযায়ী প্রস্তাবিত সব কটি মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ও মৌচাকে উড়ালসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সবচেয়ে সমস্যা হয়েছিল সেবা সংস্থার লাইন সরাতে। কিন্তু মেট্রোরেল প্রকল্পে সেই সমস্যা নেই। সেবা সংস্থার লাইন আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কাজ দ্রুত শেষ করার সব আয়োজন আছে। আমি মনে করি, কাজ ঠিকভাবেই এগোচ্ছে। বুয়েটের এই অধ্যাপক আরো বলেন, মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দেখতে সময় লাগে। শেষের দিকে কাজের গতি অনেক বেড়ে যায়। ফলে নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে আমি আশাবাদী।
জানা গেছে, মেট্রোরেলের প্রতিটি কামরা হবে সুপরিসর। সেখানে যাত্রীদের জন্য থাকবে আরামদায়ক আসন। প্রতিটি কামরা হবে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। ট্রেনে ওঠা-নামার সুবিধার্থে প্রতিটি স্টেশনে থাকবে সুপরিসর প্লাটফর্ম, যেখানে সাড়ে তিন মিনিট পরপর ট্রেন এসে দাঁড়াবে। মেট্রোরেল ব্যবস্থায় যাত্রীদের সুবিধার্থে স্টেশনে প্রবেশের সময় মেশিনে ভাড়া সংগ্রহ করা হবে। স্বয়ংক্রিয় কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করবেন যাত্রীরা।
যাত্রাপথে উত্তরা নর্থ, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা সাউথ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করবে।