শুরু সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ বাঘ ছেড়ে ডাকাত আতংকে মৌয়ালরা

হাতে ধরা লাঠি নিয়ে সামনে আগুয়ান সাজোনী (দল সাজানোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি) জয়নাল গাজী। ঠিক তার চার/পাঁচ হাত পিছনের দূরত্বে অভিন্ন প্রস্তুতিতে দলের দ্বিতীয় প্রধান কওছার।

পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী ঐ দুই ব্যক্তিকে অনুসরণ করে প্রায় সমদূরত্ব বজায় রেখে এগুতে থাকে দলের আরও নয় সদস্য। কারও হাতে মধু ধরার ধামা (আড়ি) এবং হাড়ি। আবার কারও হাতে ‘চাক’ কাটার কাজে ব্যবহৃত ধারালো দা এবং মৌমাছি বিতাড়িত করতে আগুন জ্বালানোর নুড়ি (গাছের লতা-পাতা দিয়ে তৈরি মশাল)।

পশ্চিম সুন্দরবনের কলাগাছিয়া ষ্টেশন সংলগ্ন ধানঘরা এলাকায় পৌছাতেই দলের নুড়ি বহনকারী জাকির হোসেনের চোখে পড়ে মাঝারি আকৃতির একটি মৌ-চাক। বিশেষ সংকেত এর সাহায্যে দ্রুত মুজিবর রহমান সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অল্প সময়ের মধ্যে দলের সব সদস্য তার পাশে জড়ো হয়ে প্রস্তুতি সারে চাক কাটার।
পূর্ব পরিকল্পনা মতে সবাই মুখ টুপি পরে নেয়ার পর কাটুনি বাউলে (চাক কাটার দায়িত্ব থাকে যার) নুরু গাজী গাছে চড়ে বসে।

বারেক গাজী ও লতিফসহ তিন জন মিলে নুড়িতে আগুন লাগিয়ে তিন দিক হতে ধোয়া দিতে শুরু করে মৌ-চাকে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মৌমাছি মুক্ত হতেই কাটুনি বাউলে চাক কাটার কাজে হাত লাগায়।

সাজোনী (দল নেতা) জয়নাল গাজী একই সাথে দলের আড়িয়াল (কর্তনকৃত চাকের কোষ ধামা পেতে ধরেন যিনি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আর তাই কাটুনি বাউলের সংকেত পেয়ে তিনি দাড়িয়ে যান চাক বরাবর ঐ গাছের নিচে।

প্রায় বার/চৌদ্দ হাত নিচে দাড়িয়ে ভারি ধামা (মধু ধরার কাজে ব্যবহৃত গামলা সাদৃশ্য বেতের পাত্র) হাতে একে একে ধরে নেয় কর্তনকৃত মৌ-কোষ। দলের বাকি সদস্যরা এসময় চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে ব্যস্ত থাকে আড়িয়াল (ধামা ধরা ব্যক্তি) ও কাটুনি বাউলে (গাছে চড়ে চাক কাটে বে ব্যক্তি)সহ নিজেদের নিরাপত্তায়।

তিরিশ/চল্লিশ মিনিটের অভিযান শেষে কাটুনি বাউলে গাছ থেকে নামার পর তারা একত্রিত হয়ে সংগৃহীত মধু হাড়িতে নিয়ে শুরু করে নূতন চাকের সন্ধানে আবারও পথ চলা।

অভিযানের শুরুতে প্রথম চাক হতে প্রায় চার কেজি মধু সংগ্রহ করে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের সাত সদস্যের ঐ দলটি। সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালীনি স্টেশন থেকে পাশ নিয়ে ১ এপ্রিল সুন্দরবনে প্রবেশ করে তারা।

তাদের মত আরও পঞ্চাশটিরও বেশী টি দল এ মৌসুমে পশ্চিম সুন্দরবন এলাকায় মধু সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে প্রথম দিনেই লোকালয় ছেড়েছে এবং অনেকে রয়েছে প্রবেশের অপেক্ষায়। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত তারা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশ হতে মধু সংগ্রহ করবে।

একই দিনে মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে যাওয়া দাতিনাখালী ও চাঁদনীমুখা এলাকার আরও কয়েকটি দলের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রায় অভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে মধু সংগ্রহ করছে তারা। দলের সদস্য সংখ্যা কম বেশী হওয়া ছাড়া মধু সংগ্রহের কৌশলে তাদের মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই বলে জানায় বুড়িগোয়ালীনির আমজাদ হোসেন ও চাঁদনীমুখার আজিজুর রহমানসহ অপরাপর দলের নেতারা। তবে স্থান বিশেষ মৌমাছির তৎপরতা ভেদে কম বেশী নুড়ি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান তারা।

টেংরাখালী গ্রামের আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকটি দলের প্রধান জানায় গত কয়েক বছরে বাঘের কোন উপদ্রব নেই। তারপরও প্রথা মেনে বনে প্রবেশের সময় দলের সাথে একজন করে গুনিন (বাঘের বিচরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকায় যিনি বাঘের অক্রমন থেকে দলকে নিরাপদ রাখতে সক্ষম বলে তাদের বিশ্বাস) নিয়েছে। তিনিই গোটা অভিযানের সময় দিক নির্ণয়েরও দায়িত্ব পালন করেন বলেও জানায় এসব মৌয়ালরা। যদিও কদমতলা গ্রামের আদম আলীসহ অপর কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্য ‘বাঘের কোন উপদ্রব না থাকলেও ফুরফুরা শরীফের তাবিজ নিয়ে বনে প্রবেশ করেছে তারা’।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিনে সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালীনি ষ্টেশনে আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রতিটি মৌয়াল দল গোটা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানান মৌয়াল দলগুলো। প্রাথমিকভাবে তারা পনের দিনের পাশ নিয়ে বনে প্রবেশ করেছে উল্লেখ করে জানায়, প্রথম দফায় সংগ্রহীত মধু নিয়ে তারা পনের দিন পরে ফিরবে। পরবর্তীতে নূতন পাশ তারা আবারও মধুর সন্ধানে সুন্দরবনে যাবে।

এদিকে মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে যাওয়া প্রতিটি মৌয়াল দল আপত্তি তুলেছে বনদস্যুদের তৎপরতা নিয়ে। তাদের অভিযোগ বাঘের তুলনায় বনদস্যুরা এখন সবচেয়ে বেশী ভীতির কারণ। মধু কাটতে সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য প্রতিটি বনদস্যু গ্রুপকে সদস্য পিছু তিন হাজার করে টাকা আগেই পরিশোধ করতে হয়েছে বলে জানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি মৌয়াল দল। আপাতত সুন্দরবনে তৎপর তিনটি পৃথক বনদস্যু গ্রুপকে দল প্রতি চল্লিশ থেকে নব্বই হাজার পর্যন্ত টাকা গুনতে হওয়ার তথ্য দিয়েছে এসব মৌয়াল দলগুলো।

বুড়িগোয়ালীনি স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে বনে যাওয়া আজিবর রহমানের দাবি ঝামেলায় পড়তে হবে বুঝতে পেরে বনবিভাগ থেকে অনুমতি নেয়ার আগেই দুইটি বনদস্যু গ্রুপকে সদস্য পিছু তিন হাজার করে টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। ঐ টাকার বিনিময়ে পরবর্তী এক মাস তারা সুন্দরবন থেকে নির্বিঘ্নে মধু সংগ্রহ করতে পারবে বলে দাবি তার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুন্সিগঞ্জের অপর একটি মৌয়াল দলের দল নেতা জানান, তার নয় সদস্যের দলটির জন্য প্রতিটি বনদস্যু গ্রুপকে দিতে হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে দুইটি বনদস্যু গ্রুপকে টাকা পরিশোধের কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, অপর একটি বনদস্যু গ্রুপ সমপরিমাণ অর্থ দাবি করেছে। বাধ্য হয়ে দাদন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে ঋণ নিয়ে বনে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন সুন্দরবনে প্রবেশের পর নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানোর পর বনদস্যুরা এসে দাবীকৃত টাকা নিয়ে যাবে।

এবারের মধু মৌসুমে সুন্দরবনে প্রবেশ করা প্রতিটি মৌয়াল দলকে একইভাবে বনদস্যুদের টাকা দিয়ে বনে যাওয়ার অভিযোগ করেন কালিঞ্চি, কৈখালীসহ অন্যান্য এলাকা থেকে মধু সংগ্রহে যাওয়া প্রতিটি মৌয়াল দল।

তাদের সকলের অভিযোগ বাঘের চেয়ে বনদস্যুরা এখন মৌয়ালদের জন্য ভয়ংকর হয়ে দেখা দিয়েছে। যে কারণে অনেকে বিএলসি করার পরও মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে প্রবেশ করা নিয়ে রীতিমত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।

যদিও বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে মৌয়ালদের নিরাপত্তায় বনরক্ষীসহ কোষ্টগার্ড এবং অপরাপর সংস্থাগুলো সারা বছরের মত টহলে রয়েছে। সূত্রটি আরও জানিয়েছে এবছর পশ্চিম সুন্দরবন থেকে এক হাজার ৫০ কুইন্টাল মধু এবং দুই শত ৬৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ৩০ জনু পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ চলবে বলেও জানায় বনবিভাগ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)