উত্তর কোরিয়ার সংসদ নির্বাচনে ১০০% ভোট পড়ে, কারণ কী
উত্তর কোরিয়া সারা বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন একটি দেশ। কিম পরিবার বংশপরম্পরায় দেশটি শাসন করছে। দেশটির ভোটাররা রোববার ক্ষমতাহীন রাবার স্ট্যাম্প সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন ক্ষমতা গ্রহণের পর সে দেশে দ্বিতীয়বার এই নির্বাচন হলো।
উত্তর কোরিয়ার সংসদে আনুষ্ঠানিক নাম ‘সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেমব্লি’ (এসপিএ) এবং এতে ভোটদান বাধ্যতামূলক। সরকারি তালিকার বাইরে এতে অন্য কোনো প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে না। বিরোধী দল বলেও কিছু নেই।
এই ধরনের নির্বাচনে বিশেষত্ব হলো এতে ভোটার উপস্থিতির হার থাকে ১০০%। দেশটির সরকার যে জোট তৈরি করবে সেই জোটকেই সর্বসম্মতভাবে ভোট দিতে হবে। শাসক পরিবার এবং ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখানো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক।
উত্তর কোরিয়াতে আরেকটি কড়া নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। সেটি হলো সরকারের সমর্থনে উল্লাস প্রকাশ করা উত্তর কোরীয়দের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নির্বাচনের দিনে ১৭ বছর বয়সের ওপর সব নাগরিককে ভোট দিতে হয়।
উত্তর কোরীয়বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ ফিয়োদর টার্টিস্কি। দেশটির নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে আপনাকে খুব ভোরে নির্বাচন কেন্দ্রে হাজির হতে হবে। এর মানে হলো সবাই একসঙ্গে উপস্থিত হওয়ার পর ভোটকেন্দ্র লম্বা লাইন হবে। এরপর ভোটার যখন ভোটকেন্দ্রে ঢুকবেন, তখন তার হাতে একটি ব্যালট পেপার দেয়া হবে। ব্যালট পেপারে একটাই নাম থাকবে। সেখানে কোনো কিছু লিখতে হবে না। কোনো বাক্সে টিক চিহ্ন থাকবে না। ভোটার শুধু ব্যালট পেপারটি নিয়ে একটি বাক্সে ভরে দেবে। ভোটের বাক্সটিও সাধারণত খোলা অবস্থায় রাখা হয়।’
দেশটি সম্পর্কে আরও জানা যায়, উত্তর কোরিয়ায় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কেন্দ্রে ভোটের বুথ থাকে। কিন্তু কেউ সেখানে যায় না। এর কারণ হলো বুথে গেলে সেই ভোটারের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। আপনি চাইলে ব্যালট পেপারের নামটিও কেটে দিতে পারেন। আর সেটা করলে নিশ্চিতভাবেই সরকারের গোপন পুলিশ আপনার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া শুরু করবে।
মিনইয়াং লি। তিনি উত্তর কোরিয়ার ‘এনকে নিউজ’ নামে একটি নিউজ ওয়েবসাইটের সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘ভোট দেয়া শেষ হয়ে গেলে ভোটাররা নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে যাবেন এবং সেখানে উপস্থিত অন্যান্য ভোটারদের সঙ্গে মিলে আনন্দ প্রকাশ করবেন এই কারণে যে দেশের সুযোগ্য নেতাদের প্রতি সমর্থন জানাতে পেরে আপনি খুবই খুশি।’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ায় নির্বাচনে যেহেতু ভোটদান বাধ্যতামূলক, তাই নির্বাচনের তথ্য বিশ্লেষণ করে কর্তৃপক্ষ জানতে পারে কে ভোট দিতে যায়নি কিংবা কে দেশ ছেড়ে চীনে পালিয়ে গেছে।
ভিন্নমত প্রকাশের কোন সুযোগ নেই উত্তর কোরিয়ায়
সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেমব্লি (এসপিএ) মূলত ক্ষমতাহীন, রাজনীতির ভাষায় যাকে রাবার-স্ট্যাম্প সংসদ বলা হয়। প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংসদ নির্বাচন হয়। এটিই রাষ্ট্রের একমাত্র আইন প্রণয়নকারী শাখা।
এই রাবার-স্ট্যাম্প সংসদ সম্পর্কে ফিয়োদর টার্টিস্কি বলেন, ‘আমি জানি বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায়ই বলে-এসপিএর ক্ষমতা খুবই সামান্য। কিন্তু আমি বলব এর ক্ষমতা আসলে শূন্য। উত্তর কোরিয়ার আইন তৈরি হয় ক্ষমতাসীন দলের হাতে আর সংসদ শুধুমাত্র সেগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়।’
বিশ্লেষকদের মতে, তত্ত্বগতভাবে সংসদের হাতে যে ধরনের ক্ষমতা থাকা উচিত তার লেশমাত্র নেই এসপিএর হাতে। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন পেলে সে দেশের সংবিধানকে বদলে ফেলা সম্ভব। আর সংসদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কিম জং-উনকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করাও সম্ভব। তবে সমস্যা হলো এসপিএর অধিবেশনও খুব নিয়মিতভাবে হয় না। প্রথম অধিবেশনের ছোট একটি কমিটি গঠন করা হয়, যেটি সংসদের পক্ষ হয়ে কাজ করে।
এমতাবস্থায় আপনি হয়তো ভাবতে পারেন উত্তর কোরিয়ায় বিরোধীদলের কোনো অস্তিত্বই নেই। কিন্তু জেনে অবাক হবেন যে সে দেশের সংসদে তিনটি দল রয়েছে। কিম জং-উনের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টির রয়েছে সবচেয়ে বেশি আসন। সোশাল ডেমোক্র্যাট পার্টি আর চন্ডোইস্ট চঙ্গু পার্টির সামান্য কিছু আসন রয়েছে।
তবে এই তিনটি দলের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ নেই। তারা সবাই মিলে এক জোট তৈরি করেছে যার মাধ্যমে তারা দেশ পরিচালনা করে। এই জোটের নাম ‘ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর দ্য রিইউনিফিকেশন অব কোরিয়া’।