৭ মার্চ কি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন?

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি যে অনন্য এবং অনবদ্য, এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও বিশ্বের কালজয়ী বক্তৃতার স্বীকৃতি পেয়েছে এই ভাষণ। জাতির পিতা তার এই ভাষণটিতে দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছিলেন। সবার মনে একটা প্রশ্ন, ৭ মার্চের ভাষণে কি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন? জাতির পিতার ভাষণের প্রতিটি লাইনেই লুকিয়ে আছে এর উত্তর।

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আমাদের দেশে যেমন গবেষণা হয়েছে তেমনি বিদেশি অনেক গবেষকও এই ভাষণটি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তেমনি একজন হলেন, ব্রিটেনের ইন্সটিটিউট অব কমনওয়েলথ স্টাডিজের অধ্যাপক জেমস মেনর। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণা। আর এই কৌশল অবলম্বন করে বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।’

অধ্যাপক মেনর বলেন, ‘শেখ মুজিব খুবই দূরদর্শী রাজনীতিক ছিলেন। তিনি বুঝতেন কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন ও ঐক্যবদ্ধ জনগণ। জনগণের মনোভাব তিনি খুবই ভালো বুঝতেন। দাবি আদায়ে আলোচনার টেবিলে যখন বসতেন, তখন পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়েই তিনি প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। তবে জনগণের স্বার্থের প্রশ্নেও তিনি ছিলেন আপোসহীন নেতা।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে… আর যদি আমার লোকেদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।’ ২৫ মার্চ কালরাতে একটি গুলি নয়, বরং হাজার হাজার গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে। এর ফলে তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়ে যায়।

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, ৭ মার্চ যে বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়েছিলেন তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। সেদিনের ভাষণের সবচেয়ে আগুনঝরা পঙক্তি হলো- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এখানে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন।

এজন্যই গবেষকরা বলেন, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই তিনি বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। সেদিনই তিনি স্বাধীনতা অর্জনের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিকবার জাতির পিতা ৭ মার্চের ভাষণের স্মৃতিচারণ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি বলেন, ‘গত ৭ মার্চেই আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের ওপর আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা ঘরে ঘরে দূর্গ তৈয়ার করো। আমি বলেছিলাম যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। আমি বলেছিলাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার লোকেরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলেই সংগ্রাম করেছে’। এর মাধ্যমে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই স্বীকার করে নিয়েছিলেন প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল।

১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে অনেকেই এই ইতিহাস বদলে দিতে চেয়েছেন। ২০ লাখেরও বেশি মানুষের উপস্থিতিতে জাতির পিতা যে ভাষণ দিয়েছেন তা নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন অনেকে। এমনকি এই ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। কিন্তু তবুও বাঙালি থেমে থাকেনি। এই ভাষণ শুনেই বারবার বাঙালি উজ্জীবিত হয়েছে, উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)