রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ইউক্রেন থাকবে: ট্রাম্পের আশ্বাস
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, ইউক্রেন এতে অংশ নেবে। আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়াকে নিয়ে আলোচনায় বসব, আরও অনেক দেশও থাকবে।
পুতিনকে তিনি বিশ্বাস করেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, আমি মনে করি, তিনি কিছু ঘটতে দেখতে চান। এই বিষয়ে আমি তাকে বিশ্বাস করি।
ট্রাম্প আরও বলেন, শুক্রবার মিউনিখে মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তাদের বৈঠক হবে এবং ইউক্রেনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এক উপদেষ্টা বলেছেন, শুক্রবার বার্ষিক মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নেই। তার মতে, মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি অভিন্ন অবস্থান প্রয়োজন।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, আগামী সপ্তাহে সৌদি আরবে তিন দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের (যদিও নেতা পর্যায়ের নয়) একটি বৈঠক হতে পারে, যার লক্ষ্য যুদ্ধবিরতি। বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই সিবিহার সঙ্গে ফোনালাপে যুদ্ধবিরতির জন্য সাহসী কূটনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে।
রাশিয়ার আর্থিক বাজার ও ইউক্রেনের ঋণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ এই যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। তবে ট্রাম্পের একতরফা এই উদ্যোগ এবং ইউক্রেনের প্রধান দাবিগুলোতে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত কিয়েভ ও ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তারা আশঙ্কা করছেন, হোয়াইট হাউজ তাদের বাদ দিয়ে কোনও চুক্তি করতে পারে। জেলেনস্কি বলেছেন, আমরা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের ছাড়া কোনও চুক্তি মেনে নেব না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ইউক্রেন অবশ্যই কোনও না কোনোভাবে শান্তি আলোচনায় অংশ নেবে, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনাও চলবে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতও ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির আলোচনার আয়োজক হতে চায়।
ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ট্রাম্পের শান্তি উদ্যোগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলেছেন, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কাল্লাস বলেছেন, যেকোনও দ্রুত সমাধান একটি নোংরা চুক্তি হবে।
তিনি ট্রাম্পের পূর্বানুমোদিত ছাড়ের সমালোচনা করে বলেন, আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই কেন আমরা রাশিয়াকে তারা যা চায় সব দিচ্ছি?
এক ইউরোপীয় কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার শুরু হতে যাওয়া মিউনিখ সম্মেলনে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে মন্ত্রীরা সম্মত হয়েছেন।
বুধবার ট্রাম্প ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর প্রথমবারের মতো পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন এবং এরপর জেলেনস্কিকেও ফোন করেন। তিনি বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে, উভয় নেতাই শান্তি চান। তবে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যেই বলেছে যে, ইউক্রেনের পক্ষে ২০১৪ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়া বা ন্যাটোতে যোগদান করা অবাস্তব। এছাড়া যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে ইউক্রেনে কোনও নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হলে তাতে মার্কিন সেনারা অংশ নেবে না।
তবে বৃহস্পতিবার এক মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ বা ২০১৪-পূর্ব সীমানায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যা আগের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, বিশ্ব সৌভাগ্যবান যে ট্রাম্পের মতো পৃথিবীর সেরা আলোচক দুই পক্ষকে একত্রিত করে শান্তি আলোচনা করাচ্ছেন।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেসকভ বলেছেন, মস্কো ট্রাম্পের সংকট নিরসনের ইচ্ছায় প্রভাবিত হয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। ২০২২ সালের পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর রাশিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের আরও কিছু অঞ্চল দখল করে। ইউক্রেন ২০২২ সালে রাশিয়ার সেনাদের কিয়েভের উপকণ্ঠ থেকে পিছু হটাতে সক্ষম হয় এবং কিছু অঞ্চল পুনর্দখল করে। তবে ২০২৩ সালে ইউক্রেনের ব্যর্থ পাল্টা আক্রমণের পর থেকে ধীরে ধীরে আরও অঞ্চল রাশিয়ার দখলে চলে যাচ্ছে।
এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সেনা নিহত ও আহত হয়েছে এবং ইউক্রেনের শহরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষের অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। মস্কো চাচ্ছে যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তিতে স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ থাকুক। অন্যদিকে, কিয়েভ বলছে যে রাশিয়ান সেনাদের অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে এবং ভবিষ্যত হামলা প্রতিরোধে ন্যাটো সদস্যপদের সমতুল্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেতে হবে।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা আগেই স্বীকার করেছেন যে স্বল্পমেয়াদে ন্যাটো সদস্যপদ অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে এবং একটি শান্তি চুক্তিতে কিছু দখলকৃত অঞ্চল রাশিয়ার হাতে থাকতে পারে। তবে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিবিহা বলেছেন, ন্যাটোতে যোগদানের জন্য ইউক্রেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে, যা শান্তি নিশ্চিত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে সহজ ও কম ব্যয়বহুল উপায়।
কিয়েভের বাসিন্দা মিরোস্লাভা লেসকো বলেছেন, এটি সত্যিই মনে হচ্ছে যে তারা ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণ করাতে চাইছে। কারণ এই আলোচনা বা ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে আমাদের দেশের জন্য কোনও সুবিধা দেখছি না। তবে তিন বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনীয়রা ক্লান্ত এবং অনেকেই শান্তি অর্জনের জন্য কিছু লক্ষ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রেসিডেন্ট টিমোফি মিলোভানভ বলেছেন, বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে পার্থক্য হলো, ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলছেন যা বাইডেন ভাবতেন এবং ইউক্রেন সম্পর্কে করতেন।