শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্যের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পে দূণীতির অভিযোগ

মোঃ আলফাত হোসেন ঃ সুপেয় পানির সংকটে শ্যামনগরের মানুষ এখন দিশেহারা।

দৈনন্দিন একটি পরিবারে পানযোগ্য পানির যে পরিমাণ চাহিদা, অনেক পরিবারের পক্ষেই তা পুরোপুরি মেটানো মোটেই সম্ভব হচ্ছে না সাতক্ষীরার উপকূলে।
জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর সহ বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট নিরসনে ‘সমগ্রদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে দুটি প্রকল্পের আওতায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ৩ হাজার লিটারের পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিসহ স্থাপন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের আওতায় সরকারের উপকারভোগী প্রতি ব্যয় প্রায় ৪২ হাজার ২০০ টাকা (ভ্যাট ট্যাক্সসহ)। তবে সরকারি বরাদ্দের এই পানির ট্যাংক বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
৮ হাজার ৮৫০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা খরচ করে সুপেয় পানির প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী সরকার। যেখানে অসহায়, গরীব আর পিছিয়ে পড়া মানুষকে স্বল্প মূল্যে নিরাপদ পানি দেওয়ার কথা ছিল। বরাদ্ধের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করে সরকারি কর্মকর্তা, এমপি ও দলীয় লোকজনই হয়েছেন লাভবান।
সাতক্ষীরার উপকূলজুড়ে বিশুদ্ধ পানিসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট যুগ যুগধরে,এই সংকট নিরসনে সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও তার সুফল পাচ্ছে না শ্যামনগর সহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানির ড্রাম বিতরণের প্রকল্প শুধু টাকা খরচের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যেভাবেই ছিল, সেভাবেই পড়ে আছে এই সংকট। মাঝে কোটিপতির সুফল পাচ্ছেন দুর্নীতিবাজরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের টেকনিশিয়ান দাবি করা ঠিকাদারের প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা সমাজের বিত্তবান ও স্বচ্ছল চাকরীজীবীদের কাছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় ফেরি করে বিক্রি করছেন এসব ট্যাংক। এই অনিয়মের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত বলে অভিযোগ এলাকাবাসী। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদার প্রতিনিধির যোগসাজশে সরকারের কোটি কোটি টাকা তছরুপ হচ্ছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে তালিকা পাওয়া গেছে সেই তালিকা অনুযায়ীই ট্যাংকি বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের দুর্নীতির কোন সুযোগ নেই।
এদিকে প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম বলেন, অফিস থেকে যে তালিকা দেয়া হয়েছে, সেই তালিকা অনুযায়ী আমরা ট্যাংকি বিতরণ করছি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়,শ্যামনগরের রমজাননগর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ফারুক হোসেনের বাড়িতে একটা পরিবারে ৪ টা ড্রাম পাওয়া যায় এদিকে খাবার পানি সংকটে থাকা প্রকৃত অসহায় দরিদ্র মানুষের পরিবর্তে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বিত্তবান ও চাকরিজীবীদের মাঝে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পানির ট্যাংকি বিতরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ের ট্যাংকি পাওয়া বিত্তবান ও চাকরিজীবীদের দাবি, তিন হাজার লিটারের একটি পানির ট্যাংক দোকানে কিনতে গেলে ২৫থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু ১০ থেকে ১২হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে শুনে তাদের কাছ থেকে ক্রয় করেছেন অনেকেই।

সুন্দরবনের কোণঘেঁষা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর। নদী এলাকা হওয়ায় এই উপজেলার অধিকাংশ এলাকার পানি লবণাক্ত। তাই বসানো যায় না গভীর নলকূপ। বর্ষাকালে পানিতে লবণাক্ততা কম থাকলেও শুকনো মৌসুমে মানুষকে মারাত্মক কষ্ট পোহাতে হয়। দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে ও পান করতে তখন একমাত্র অবলম্বন পুকুর এবং ধরে রাখা হয় বৃষ্টির পানি,অথচ সেই পানির কষ্টে থাকা উপকূলের গরীব অসহায় মানুষই পাচ্ছে না সরকারের এই সুবিধা। অর্থের বিনিময়ে এই প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সুপেয় পানির কষ্ট দূর করতে সমগ্রদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ নামে দুইটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় উপকারভোগীদের বাড়িতে তিন হাজার লিটার বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হয়। এজন্য উপকারভোগীদের ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।
কিন্তু শ্যামনগরে এজন্য উপকারভোগীদের গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। যা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ঠিকাদারের প্রতিনিধি ও তার লোকজন নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফলে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হলেও বিত্তবানরা ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে একের অধিক সরকারি ট্যাংক ক্রয় করছেন। অথচ ট্যাংকের গায়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা হিসেবে লেখা আছে, ‘জলধারাটি ক্রয় ও বিক্রয় সমভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানির কষ্টে থাকা এলাকাবাসীর অভিযোগ, দেড়-দুই বছর আগে পানির ট্যাংকি বাবদ টাকা জমা দিলেও তারা এখনো পানির ট্যাংক পাননি। অথচ যারা নগদ টাকায় ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে পানির ট্যাংক কিনছেন সেসব বড়লোকের (বিত্তবানদের) বাড়িতে পানির ট্যাংক পৌঁছে গেছে।

কৈখালী ইউনিয়নের শাররীক প্রতিবন্ধী মাসুমা খাতুন বলেন, আমাদের এলাকায় খাবার পানি খুবই অভাব,সরকার আমাদের এই এলাকার মানুষের কথা ভেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানি পান করার জন্য পানির ড্রাম দিচ্ছে। কিন্তু পানির ড্রাম গরীব অসহায় মানুষ না পেয়ে এলাকার বিত্তবানরাই পাচ্ছে।
পশ্চিম কৈখালী গ্রামের পানি নিতে আসা এক পথিক মহিলা বলেন, দিনে দু-তিনবার অনেক দূর হেঁটে পানি আনতে হয়। জীবন আর পারে না। পানির পাত্র না থাকায় বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখতে পারিনি। শুনেছি সরকার থেকে তিন হাজার লিটারের পানির ট্যাংকি দেচ্ছে, অনেকের সাথে বলেছি কিন্তু কেউ দেইনি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)