কালিগঞ্জের ধলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

রঘুনাথ খাঁ: বাবার রেজিষ্ট্রি বন্টনকৃত তিনটি দলিল থেকে দুই বোনের ২৩ বিঘা জমি ফাঁকি দিতে সাতক্ষীরা জেলা সাব রেজিষ্টার অফিসের মূল ভলিউম রেজিষ্টার থেকে পাতা ছিঁড়ে সত্যায়িত জাল দলিল তৈরির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কালিগঞ্জের ধলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেনসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক ও খুলনা সমন্বিত কার্যালয়ের সাথে সংযুক্ত মো. জাহিদ ফজল বাদী হয়ে বুধবার বিকেলে দুদকের খুলনা সমন্বিত কার্যালয়ে এ মামলা দায়ের করেন।
মামলার আসামীরা হলেন, খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার তালবাড়িয়া গ্রামের গোলক রায় এর ছেলে ও সাতক্ষীরা জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নকলনবীশ অনল কৃষ্ণ রায় (৩৮), কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে সদর সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের অবসরপ্রাপ্ত অফিস সহকাারি কাজী আবুল বাশার (৬৫), কালিগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের আবু জাফর গাজীর ছেলে ইয়াছিন আরাফাত শাওন (৩৫), সাতক্ষীরা সদরের কাটিয়ার মৃত রমজান আলীর ছেলে বরখাস্তকৃত দরিল লেখক এম এম শাহজাহান (৫৫) ও কালিগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের প্রয়াত খোরশেদ চেয়ারম্যানের ছেলে ধলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত হোসেন (৫৫)।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯৩ সালে ও ১৯৯৫ সালে কালিগঞ্জ সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে সম্পাদনকৃত ৩০৭৭/১৯৯৩, ৪৫২০/১৯৯৩ এবং ৩৭৬১/১৯৯৫- কোবালা দলিলের বালাম বই থেকে কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে পরষ্পর যোগসাজসে আসামীরা জাল সার্টিফাইড কপি তৈরি করেন। এসব জাল দলিল মূল দলিল হিসেবে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে বালাম বহি থেকে পাতা ছিঁড়ে নষ্ট করা হয়।
বিষয়টি ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর সাতক্ষীরা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘটনাটি ধরা পড়ে। নকলনবীশ মো. আবু বাশারত বিষয়টি সন্দেহ করে সহকর্মীদের জানান। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা অপরাধ স্বীকার করলে পুলিশ উপরোক্ত পাঁচ আসামীকে গ্রেপ্তার করে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে। বিষয়টি দুদকের এখতিয়ার বলে সদর থানায় মামলা করা হয়নি।খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. জাহিদ ফজল বলেন, ঘটনাটি যখন ঘটেছিল তখন আমাদের কমিশন ছিল না। থানায় অভিযোগ যাওয়ার পর তারা আসামিদের গ্রেপ্তার করে। পরে দেখা যায় এটি দুদকের সিডিউলভুক্ত অপরাধ। এ কারণে মামলাটি দুদকের হেড অফিসে পাঠানো হয়। হেড অফিসের অনুমতি সাপেক্ষে মামলা(১নং) করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ যশোরের বাঘারপাড়া থেকে সাতক্ষীরা সদর সাব রেজিষ্টিার হিসেবে যেগেদান করেন রিপন মুন্সি। ওই মাসেই জেলা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সভায় পরিচয় প্রদানকালে জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবীর জানতে পারেন যে রিপন মুন্সি অফিস সহকারি থেকে পদায়ন হয়ে (বিসিএস ক্যাডার না হয়ে) সাব রেজিষ্টার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এতে ওই সভায় অনেকেই অবাক হয়ে যান। এরপর থেকে নকল নবীশ খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার অনল কুমার রায়কে নিজের কাছের লোক মনে করে তাকে দিয়ে অনেক অবৈধ দলিল তৈরি করেছেন। একপর্যায়ে অনল রিপন মুন্সির কাছ থেকে সরে আসেন। এতে ক্ষুব্ধ ছিলেন সদর সাব রেজিষ্টার। সাব রেজিষ্টারের বিরুদ্ধে সিÐিগেট তৈরি করে অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা উপর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের কয়েকজন দলিল লেখক ও ভলিউম রাইটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের জানান, অনিয়ম ও দূর্ণীতির কারণে শহরের কাটিয়ার দলিল লেখক এসএম শাওজাহানকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তিনি স্ত্রীর নামে স্ট্যাম্প ভেÐার পরিচালনা করে আসছেন। জমির হারির সাত লাখ ৯২ হাজার টাকা ফেরৎ পেতে আদালতে গত ১০ অক্টোবর ধলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেন ও তার ভাই আবু জাফর গাজীসহ সাত জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন তাদের ভাগ্নে ইমরান হোসেন। বোনদের ২৩ বিঘা জমি ফাঁকি দিতে গাজী শওকত হোসেন গত ১৪ অক্টোবর রেজিষ্ট্রি অফিসে জালিয়াতির শীর্ষস্থানে থাকা এসএম শাওজাহান এর শরনাপন্ন হন। শাহাজাান বিষয়টি অবসরপ্রাপ্ত অফিস সহকারি আবুল বাসার(বর্তমানে সদর সাব রেজিষ্টারের নির্দেশে কর্মরত) এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। চারটি দলিলের ভলিউমের পাতা ছিঁড়ে নতুন স্টাম্পে দাতার নাম ঠিক রেখে গ্রহীতা লতিফা ও জাহানারার নামের পরিবর্তে গাজী শওকত হোসেন ও আবু জাফর এর নাম বাসিয়ে দেওয়ার শর্তে চুক্তি হয় পাঁচ লাখ টাকার। পরিবর্তিত ভলিউম অনুযায়ি তিনটি জাল দলিল তুলতে আবুল বাসার পান ২০ হাজার টাকা। তবে ভলিউমের পাতা ছেঁড়ার ব্যাপারে মোটা অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে নকলনবীশ অনল কুমার রায় এর বিরুদ্ধে। তবে এ ঘটনায় জালিয়াতির মূল হোতা হিসেবে রিপন মুন্সিকে অনেকেই দায়ী করে তাকে দুদকের হাতে তুলে দেওয়ার আহবান জানান।
সূত্রটি আরা জানায়, ইয়াছিন আরাফাত শাওন আটক হওয়ার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেন বিভিন্ন স্থানে দেনদরবার করেন। এরই মধ্যে পিওন মহসিনকে দিয়ে একে এক এসএম শাহজাহান, আবুল বাসার ও অনল রায়কে অফিসে ডাকান রেজিষ্টার রিপন মুন্সি। তড়িঘড়ি করে অনল রায়কে অফিসের মধ্যে ঢুকিয়ে দলিল লেখকদের পিটানি থেকে বাঁচানোর কথা বলে ভলিউমের পাতা ছেঁড়া সংক্রান্ত একটি কম্পিউটার করা কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেন রিপন মুন্সি। একপর্যায়ে সদর সাব রেজিষ্টারকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ভাইপোকে ছাড়িয়ে নিতে রাত সাতটার দিকে রেজিষ্ট্রি অফিসে আসেন গাজী শওকত। ইয়াছিন আরাফাত ওরফে শাওন, সাতক্ষীরা সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের বরখাস্তকৃত দলিল লেখক এসএম শাহজাহান, সাতক্ষীরা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের সাবেক অফিস সহকারি কাজী আবুল বাসার ও অনল কুমার রায়কে ্একটি ঘরে আটক রাখা হলেও চুক্তি অনুযায়ি রিপন মুন্সি চেয়ারম্যান শওকত হোসেনকে রেকর্ডরুমে লুকিয়ে রাখেন। রাত ৯টার দিকে শওকত ব্যতীত বাকী চারজনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার পর একজন নকল নবীশ, পিওন মহসিন ও কর্মকর্তা পরিমলের সঙ্গে পরামর্শ করে নৈশপ্রহরী ফজলুর মাধ্যমে গাজী শওকতকে নিরাপদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গাজী শওকত রেকর্ড রুম থেকে নীচে নামা মাত্রই সাংবাদিকদের বাধার মুখে পড়েন। জালিয়াতির হোতা গাজী শওকতকে কে পুলিশে দেওয়া হয়নি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাকে ক্লিন সার্টিফিকেট দেন সাব রেজিষ্টার রিপন মুন্সি। তবে সাংবাদিকরা খবর দিলে পুলিশ রাত একটার দিকে শওকতকে থানায় নিয়ে যায়। জালিয়াতির ঘটনায় রেকর্ড কিপার প্রদীপ ঘোষ থানায় ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে ১৭ অক্টোবর ২১ নং মামলা দাখিল করলেও পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তণ করে মামলার দায়িত্ব দূর্ণীতি দমন কমিশনের উপর ন্যস্ত করে ৫৪ ধারায় মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
সদর সাব রেজিষ্টার রিপন মুন্সির বিরুদ্ধে বাঘারপাড়া সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে চাকুরি করা কালিন নারী কেলেঙ্কারীর মামলা ছাড়াও সাতক্ষীরা অফিসে অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে দলিল তৈরিতে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ, হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি বিক্রিতে দলিল পিছু ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ ছাড়াও হাজারো অভিযোগ রয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)