কাগজসংকটে প্রতিদিন কম ছাপতে হচ্ছে ২০ লাখ কপি পাঠ্যবই
অনলাইন ডেস্ক:
সরকারের বিনা মূল্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সময় আরো দীর্ঘ হচ্ছে! কারণ কাগজের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন প্রেস মালিকরা। তারা কাগজসংকটে কার্যাদেশ পেয়েও বই ছাপাতে পারছেন না। জানা গেছে, ১১৬টি ছাপাখানা দিনে ৪০ লাখ কপি পাঠ্যবই ছাপাতে পারে। তবে কাগজসংকটের কারণে তারা দিনে ২০ লাখের বেশি ছাপাতে পারছে না।
এদিকে কাগজসংকটের বড় কারণ হলো পাঠ্যবই না ছাপিয়ে অবৈধ নোট-গাইড বই ছাপানো। এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছেন না একশ্রেণির প্রেস মালিক। তারা অধিক মূল্যে কাগজ ক্রয় করে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছেন। পাঠ্যবই ছাপানোর চেয়ে গাইড বই ছাপিয়ে ২০ গুণ বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। এ কারণে দেদার ছাপিয়ে চলেছেন নোট-গাইড বই। সরকারের কাছে এমন তথ্য আসার পর ডিসিদের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসককে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই ছাপা পুরো জানুয়ারি মাস জুড়ে চলবে। এ সময়ে ৪০ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজে নিযুক্ত প্রেসসমূহে যেন নোট ও গাইড বই, ডায়ারি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বলা হলো। চিঠিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে ১১৬টি প্রেসের ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে। আরো কয়েক জন জেলা প্রশাসককে একই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম ও সমমান শ্রেণির বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর আগে সব ধরনের সহায়ক বই বা নোট-গাইড বই ছাপা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবি জানায়, বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের কাজ চলমান আছে। কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখা ও বেগবান করা সংশ্লিষ্ট সবার জাতীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের যথা সময়ে পাঠ্যপুস্তক প্রাপ্তিতে সহায়তার জন্য পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ কার্যক্রম শেষের আগ পর্যন্ত সকল প্রকার সহায়ক বই মুদ্রণ থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হলো। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য ডিসিদের কাছে পাঠানো চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি।
সরেজমিন অনুসন্ধানে ও ১৫ জন ছাপাখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য যে পরিমাণ কাগজ তাদের প্রয়োজন, তার অর্ধেক কাগজই তারা পাচ্ছেন না। সংকটকে পুঁজি করে কাগজের মিল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট ১০ দিনের ব্যবধানে টনপ্রতি কাগজের মূল্য ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাও আবার মান নিম্নমানের। অধিক মূল্যে ক্রয় করে এসব কাগজে বই ছাপাতে গেলে এনসিটিবির মনিটরিং টিম রিজেক্ট করে দিচ্ছে। মাত্র চারটি মিল কোম্পানি ভালো মানের কাগজ সরবরাহ করছে। তবে তারা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পাচ্ছে না। কাগজের মূল্য বৃদ্ধি ও সংকটের এই বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবিকে অবহিত পৃষ্ঠা করেছেন প্রেস মালিকরা।
তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেন, প্রেস মালিকরা বুঝেশুনেই দরপত্র দিয়ে কাজ নিয়েছেন। যেভাবেই হোক তারা বই দেবেন। সঠিক সময়ে বই দিতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রেস মালিকরা বলেন, অন্যান্য বছর সেপ্টেম্বর মাসে বই ছাপানোর কাজ শুরু হয়। এবার শুরু হয়েছে ডিসেম্বরে। ছয় মাসের কাজ এক মাসে শেষ করতে এমনিতে তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর কাগজের সংকটে তারা দিশেহারা। কয়েকটি ছাপাখানা পাঠ্যবই না ছেপে গাইড বই ছাপানোর ঘটনা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।
গাইড বই ছাপিয়ে কারখানায় মজুত রাখা হয়েছে: অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৫ বছর ধরে অবৈধ গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য করে আসছে লেকচার, পাঞ্জেরী, অ্যাডভান্সড, পপিসহ ৫০টি পাবলিকেশন্স। এদের অধিকাংশই আবার পাঠ্যবই ছাপানোর কাজও পেয়েছে। কিন্তু তারা পাঠ্যবইকে গুরুত্ব না দিয়ে গাইড বই ছাপানোর কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে। ছাপানো গাইড বইগুলো তারা কারখানায় মজুত করে রেখেছে।
অর্থের বিনিময়ে নিম্নমানের কাগজকে ভালো মানের সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগ: এ বছর এনসিটিবি মাধ্যমিক স্তরের বই তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে ‘ব্যুরো ভেরিটাস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রাথমিক স্তরের বই তদারকির দায়িত্বে রয়েছে ‘ফিনিক্স’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। অর্থের বিনিময়ে নিম্নমানের পাঠ্যবইয়ের কাগজকে ভালো মানের সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে—এমন অভিযোগ উঠেছে ‘ব্যুরো ভেরিটাসে’র ডেপুটি ম্যানেজার আফজাল কবিরের বিরুদ্ধে। বড় প্রেসের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ও ছোট প্রেসের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে আফজাল কবিরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
গত ১ জানুয়ারি ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্শন উদ্বোধন ও মোড়ক উন্মোচন’ অনুষ্ঠানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে সকল শ্রেণির বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে। তবে কাগজ সংকটের কারণে এ সময়ে সব বই পৌঁছানোর সম্ভব হচ্ছে না।
দুটি প্রেস থেকে অবৈধ নোট গাইড ধ্বংস
সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যে-সব প্রেস নোট-গাইড ছাপার কাজ করছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে এবার কঠোর অবস্থানে গেছে সরকার। জানা গেছে, গতকাল সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অভিযান পরিচালনা করে দুটি প্রেস থেকে অবৈধ নোট গাইড ধ্বংস করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে লেটার এন্ড কালার প্রিন্ট এবং অনুপম প্রিন্ট নামের দুটি প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান। যারা ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবির বই ছাপানোর কাজ করছেন।