বেক্সিমকো-এস আলমে ডুবেছে জনতা ব্যাংক
অনলাইন ডেস্ক:
* ২০ হাজার কোটি টাকার জরুরি বেলআউট দাবি
* যোগসাজশে আমানতকারীদের পুরো অর্থ আত্মসাৎ
* ২৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা খেলাপি বেক্সিমকো আরো ঋণ চায়
* ৯ মাসে লোকসান ১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা
* সরকারের কাছে দেওয়া চিঠিতে চেয়ারম্যানের উদ্বেগ
বড় ব্যবসায়িক ঋণ কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক জরুরি বেলআউটের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন চেয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। ১০ শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহক সময়মতো টাকা ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংকটির ৬১ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এ কারণে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটি ১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ ঋণের অর্থের বেশিরভাগই বিগত শাসনামলে বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপ এবং অ্যাননটেক্স-সহ কয়েকটি বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী নিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবুর রহমান বিদ্যমান সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংকটাপন্ন ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৩৯ হাজার কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণের কারণে জনতা ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ২০২১, ২০২২ এবং ২০২৩ এই তিন বছরে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ বেড়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অল্প কিছু গ্রাহকের অনুকূলে ঋণের বড় অংশ পরিশোধ এবং ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটিকে তারল্য সংকটে পড়তে হয়েছে।
২০২২ সালের মার্চ মাসে জনতা ব্যাংক প্রথমবারের মতো প্রতিদিনের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখার জন্য মুদ্রা বাজার থেকে ২৭২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু ঋণ অনিয়মের কারণে ব্যাংকের আর্থিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সুপরিচিত বড় ঋণগ্রহীতারা সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে আমানতকারীদের পুরো অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তথ্যে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের ৪৫ শতাংশের বেশি ঋণ মাত্র পাঁচটি শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপের কাছে জমা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান গত বছরগুলোতে ব্যাংক থেকে ‘অনিয়ন্ত্রিত’ ঋণ নিয়েছেন। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ নিয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এস আলম, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং থার্মেক্স গ্রুপ যথাক্রমে নিয়েছে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা, ৭০০ কোটি টাকা এবং ২ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি সরকারের কাছে দেওয়া একটি চিঠিতে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, জনতা ব্যাংকের ইতিহাসে এমন নাজুক অবস্থা আর কখনো হয়নি। ব্যাংকটি এখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সম্প্রতি এক সভায়ও নাজুক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হয়।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ব্যাংকটি। গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকটির বড় গ্রাহকদের অনেকেই কারাগারে, আত্মগোপনে বা দেশের বাইরে।
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পেয়েছেন মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খেলাপি ঋণ আদায়ে পথনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমাদের গ্রাহকদের বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ী। তাই এসব ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রের সহায়তা লাগবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগ্রাসী কায়দায় ব্যাংকটি থেকে ঋণ নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। ২০২১ সালে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ছিল ১৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকায়। এই ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি। ব্যাংক থেকে নতুন করে আবারো ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছে গ্রুপটি। অথচ হাজার কোটি টাকার বেশি রফতানি আয় দেশে ফেরত আনছে না তারা।
আদালতের আদেশে বেক্সিমকো গ্রুপে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক রুহুল আমিনকে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। এখন সাবকন্ট্রাকে বা উপচুক্তিতে কাজ শুরু হয়েছে। ফলে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে না পারায় রফতানি আদেশ আসছে না। সামনে ব্যাংক লেনদেন স্বাভাবিক হয়ে গেলে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাবে। তখন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করা হবে।
অর্থ সচিবকে দেওয়া জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের চিঠি অনুযায়ী, ঋণ অনাদায়ী হওয়ায় ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটির এখন নতুন করে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও নেই। এই অবস্থায় অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে চলাও অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
চিঠিতে ফজলুর রহমান লিখেছেন, ‘বড় গ্রাহকদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঋণ আদায় না হওয়া সত্ত্বেও অব্যাহতভাবে ঋণ প্রদান করায় গুটিকয়েক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, ব্যাংকও আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছে। এখন যদি ধারের টাকায় এসব গ্রাহককে নতুন করে ঋণ দেওয়া হয়, তবে বিদ্যমান সংকট থেকে জনতা ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
সম্প্রতি বেক্সিমকো গ্রুপের ৬০ কোটি টাকার একটি ঋণ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে জনতা ব্যাংক। বর্তমানে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ৩৯ হাজার ৮৬ কোটি টাকা হয়েছে। মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ইতিহাসে এমন নাজুক অবস্থা কখনো হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২১.২২ শতাংশ।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বলছেন, জনতা ব্যাংকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বৃহৎ গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের বিকল্প নেই। রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ছাড়া জনতা ব্যাংকের সংকট কাটিয়ে ওঠা তথা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটি গত কয়েক বছরে কিছু শাখার মাধ্যমে অল্পকিছু গ্রাহকের অনুকূলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঋণ বিতরণ করেছে। একক গ্রাহক ঋণসীমাসহ অন্যান্য বিধিবিধান লঙ্ঘন করে বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপ, থার্মেক্স-সহ কিছু গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ আগ্রাসীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কোম্পানির নামে ঋণ বাড়লেও যথাযথভাবে ঋণ আদায় না হওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার কারণে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে ধার করে চলতে হচ্ছে। ব্যাংকের মালিক হিসেবে বিষয়টি সরকারের জন্যও উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাংকখাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় বড় গ্রুপের কাছে পাওনার বিপরীতে কী পরিমাণ জামানত রয়েছে, তার মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গাইডলাইন চাওয়ার মানে হলো ব্যাংকটি বাঁচাতে সরকারের কাছ থেকে টাকা চাওয়া, জনতা ব্যাংকের সমস্যা সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া।
তিনি বলেন, সরকারের কাছে গাইডলাইন চাওয়ার আগে জনতা ব্যাংকের নিজস্ব কর্মসূচি প্রণয়ন করা জরুরি। এসব গ্রাহকদের কাছে ঋণের পরিমাণ কত, তার বিপরীতে জামানতের মূল্য নির্ধারণ করা এবং ঋণ আদায়ের কৌশল চূড়ান্ত করতে হবে জনতা ব্যাংককে। ভবিষ্যতে যেন খেলাপি না বাড়ে, সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে কোথাও সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের জন্য সরকারের কাছে সহায়তা চাইতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি কোম্পানি এস আলম ও বেক্সিমকো উভয়েই জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে। এই দুই কোম্পানি যেখানে ছোবল মারে, সেখানে কোনো কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
তিনি আরো বলেন, জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এভাবে একটি ব্যাংক চলতে পারে না। বেক্সিমকো ও এস আলম- এর সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা আদায় করতে হবে। তা নাহলে জনতা ব্যাংকের মতো শ্বেতহস্তি লালন-পালন করার দরকার নেই। ব্যাংকটিকে হয় অবলোপন করতে হবে, না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়াই শ্রেয়।