টাকা ছাপিয়েও মেটানো যায়নি ব্যাংক খাতের সমস্যা

অনলাইন ডেস্ক:

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাট করে রেখে যাওয়া ব্যাংক খাত সবল করতে নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর্থিক খাতের বিভিন্ন জায়গায় উন্নতি করলেও বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু সমস্যা নিরসনে নতুন টাকা ছাপানো হয়েছে। এ নিয়ে দেশের ব্যাংক খাতে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। বিশেষ করে টাকা ছাপিয়ে তারল্যসংকটে পড়া ছয় ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, এমন খবরে এ আলোচনার পালে হাওয়া লেগেছে।

তবে আশার দিক হলো সদ্য সমাপ্ত নভেম্বর মাসেও রফতানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। যদিও তারল্য সংকট তীব্র হওয়ার কারণে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে। এর মধ্যেই অর্থনৈতিক খাতে ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে হাজারও দুর্নীতির বাস্তব চিত্র। তারপরও সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিত্তি দিতে।

এদিকে, ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার জন্য তিন শ্রেণির ব্যক্তিদের দায় দেখতে পেয়েছে অর্থনীতির হালচাল জানতে গঠিত কমিটি, যাদের তৈরি শ্বেতপত্রে বেসরকারি ১০টি ব্যাংক ‘ভেতরে ভেতরে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে’ চলে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘ডিসেকশন অব এ ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রকাশ হবে। শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং ভয়ংকর রকমের আর্থিক কারচুপির যে চিত্র প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম নিয়ে বলা হয়, ‘রাজনৈতিকভাবে’ প্রভাবিত ঋণ প্রদানের অনুশীলন ব্যাংকিং খাতের ‘সংকটকে গভীরতর’ করেছে।

শ্বেতপত্রের খসড়ায় বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা ও বাইরের প্রভাবশালীদের যৌথ নেতৃত্বে সংঘঠিত বিভিন্ন অনিয়মে ব্যাংক খাত এমন বিপর্যস্ত অবস্থা তৈরি হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালে এমনটি যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, এর আগে তা দেখা যায়নি।

খেলাপি ঋণকে ব্যাংক খাতের ‘কালো গর্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে শ্বেতপত্রে বলা হয়, ব্যাংক খাতের সমস্যা যতটুকু দৃশ্যমান হচ্ছে এর চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি অদৃশ্য রয়ে গেছে।

মূলত ২০১০ সাল থেকে দেশের ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া শুরু করে। এ কারণে ব্যাংক খাতের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ঋণই খারাপ বা খেলাপি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যা দেখাচ্ছে, এর চেয়ে অনেক বেশি ঋণ খারাপ হয়ে গেছে। আর্থিক প্রতিবেদনে কাগজে কলমে ‘উইন্ডো ড্রেসিং’ করে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। এতে বলা হয়, বেসরকারি ১০টি ব্যাংক ভেতরে ভেতরে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। তারল্য সংকট তীব্র হওয়ায় এসব ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পড়বে।

খেলাপি ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করা, পুনগর্ঠন করা, অবলোপন ও সুদ ছাড় দেওয়ায় বিতরণ করা ঋণে খেলাপির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। খারাপ ঋণের অংক গত জুন শেষে পৌনে সাত লাখ কোটি টাকায় চলে গেছে বলে তুলে ধরা হয় শ্বেতপত্রে। তবে সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ‘দখল-দারিত্বে’ পরিণত হয়েছিল; ‘ক্রনিইজম’ ব্যবসায়িক মডেলে পরিণত হয়। ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ মানে হচ্ছে এমন এক অর্থ ব্যবস্থা, যেখানে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ ও সরকারি আমলাদের সঙ্গে মিলেমিশে অর্থ ব্যবস্থাকে নিজেদের মতো পরিচালিত করেন।

ব্যাংকের দুরবস্থার জন্য সরকার, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্ব ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, এক শ্রেণির ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বলেছে, নষ্ট আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে অসৎভাবে দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাত লুটপাট করেছে। পুরো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ যখন নষ্টদের হাতে চলে যায় তখন কোনো সিস্টেমই কাজ করে না। জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্র না থাকায় ধীরে ধীরে ব্যাংক খাত ধ্বংস হয়েছে। এখন আমরা জানতে পারছি কতটা খারাপ হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। যারা দায়ী তাদের নাম প্রকাশ করা উচিত। তাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে ভবিষ্যতে কেউ সাহস করবে না অপরাধের পুনরাবৃত্তি করার।

আর্থিক খাতের মধ্যে ব্যাংকগুলোর সম্পদের আকার গত জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৭ শতাংশ। ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ হচ্ছে ১৮ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩৪ শতাংশ। গত ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়। অর্থনীতির এমন অবস্থা বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়াকে গুরুত্বর্পূণ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়।

কিন্তু ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকা ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে শুরু করে মূলত ২০১০ সালের পর থেকে।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নেতৃত্বেও বদল হয়। সেই বদলের পড়ে আইএমএফর শর্ত বাস্তবায়ন ও আগের অনেক নীতি বাদ দেওয়া শুরু হয় বলেও শ্বেতপত্রে বলা হয়। আর্থিক খাতের দৈন্য দশা কাটাতে ২০২২ সালের মে মাস থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরর নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। এখন নীতিসুদ হার ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামনের দিকেও সহায়তা করবে বলে মনে হয়।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত বেড়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখানো খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। সেখানে চলতি বছরের জুন শেষে ১২ শতাংশ পার হয়ে যায়। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৮ শতাংশই হচ্ছে মন্দ মানের ঋণ।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকসহ শরীয়াহভিত্তিক প্রায় সব ব্যাংক, কয়েকটি বেসরকারি খাতের প্রচলিত ব্যাংক এখন তীব্র তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমানতের সুদহার বাড়লেও ব্যাংকগুলোর টাকার অভাব কাটছে না ব্যাংকের টাকার অভাব। আমানতের সুদহার বাড়ানোসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোর টাকার অভাব কাটছে না। ফলে, কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক সংকট আরো বেড়েছে।

গত ২৩ নভেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৯০ দিনের মেয়াদি ঋণের সুদের হার সর্বকালের সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়। একইভাবে নভেম্বরে তলবি মুদ্রাবাজারে (কল মানি) এক দিনের (ওভারনাইট) সুদের গড় হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। গত বছরের একই মাসে তা ছিল আট দশমিক ১৯ শতাংশ। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোয় সম্পদ বাড়লেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশে আছে মন্দ ঋণ। এটি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কম। এসব খেলাপি ঋণের কারণে নতুন করে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকে টাকা না আসায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। উপরন্তু, পাচার হওয়া টাকা ও ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার সম্ভাবনা সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ সব ঘটনা আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে বেশি সুদ নিতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- নতুন করে আর টাকা ছাপানো হবে না। তবে চার মাস না যেতেই আগের অবস্থান বদল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ছয় ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে আরো টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর। হঠাৎ অবস্থান বদল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে চরম সংকটে পড়েছে সাতটি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্সিম ব্যাংককে ৫ হাজার কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ৪ হাজার কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংককে ৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, যা আগস্টে ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে ছাপানো টাকার পরিমাণ কমে ১০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। একই মাসে বাজারে প্রচলিত টাকার পরিমাণও কমে আসে। সেপ্টেম্বরে বাজারে চালু থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যা আগস্টে ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। আগস্টে ব্যাংকের বাইরে মানুষের কাছে নগদে (হাতে ও বাড়িতে) ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে কমে হয় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়াতে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এই সময়ে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেশি। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ও আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

এদিকে নভেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছে ১৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর থেকে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করেছে। এনবিআরের হিসাবে, গত মাসে রফতানি হয়েছে ৪১৩ কোটি ডলারের পণ্য।

নভেম্বরে প্রবাসী আয়ও বেড়েছে। রফতানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, বিপরীতে আমদানি ব্যয় সেভাবে না বাড়ায় সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি দূর হয়েছে। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি কমছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-সহ বহুপক্ষীয় এবং বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ ও বাজেট সহায়তার প্রাথমিক আশ্বাস দিয়েছে। এই নভেম্বরেই বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ঋণচুক্তি হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)