চলতি বাজেটে ব্যয় কমানো হচ্ছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা

অনলাইন ডেস্ক:
কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ না হওয়ায় বড় ধরনের কাটছাঁট হতে যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের বাজেট। অর্থ সাশ্রয়ে বাদ দেওয়া হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সরকারিভাবে কৃচ্ছ সাধন চলছে। ব্যয়ের লাগাম টানতে মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্ধারিত বরাদ্দের বাইরে নতুন অর্থ দেওয়া হচ্ছে না। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটের ব্যয় থেকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কো-অর্ডিন্যান্স কাউন্সিল বৈঠকে নেওয়া হয় এ সিদ্ধান্ত। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানসহ অর্থ সচিব এবং আর্থিক বিভাগের সচিবও উপস্থিত ছিলেন।

গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটি কাটছাঁট করে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনছে।

সূত্রমতে, কো-অর্ডিন্যান্স কাউন্সিল বৈঠকে সরকারের আয়-ব্যয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে এনবিআর কর ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত আয় ৪৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় জুলাই ও আগস্টে রাজস্ব আদায় বাধাগ্রস্ত হয়। এ অস্থিরতা ছাড়াও দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমদানিতে ধীরগতি ও নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড়ের ফলে কম আদায়ের কারণ ভূমিকা রেখেছে।

এনবিআর তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে এক লাখ এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা। প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি ৩০ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা কম।

অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। ফলে মন্দা এড়াতে সরকারি উন্নয়ন খরচ বাড়ানোর পরিবর্তে কমাতে হচ্ছে। অর্থবছরের শুরুতে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট ধরলেও মাঝামাঝিতে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যয় কমছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। কাটছাঁটের সিদ্ধান্তের আগেই অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডি জানিয়েছে, উন্নয়ন খরচ গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এডিপির আওতায় ১ হাজার ৩২৬টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে অনেক ২০২৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যয় দেখা যায়নি। অর্থ বিভাগের নির্দেশনা বলেছে সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা সীমিত রাখা বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানে বাস্তবায়িত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে।

এদিকে চলমান আর্থিক পরিস্থিতিতে সরকারের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া কঠিন। অন্যদিকে, বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি আগের বছরগুলোর তুলনায় কমেছে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে অর্থ বিভাগ। কারণ আয় না বাড়লেও ব্যয় থেমে থাকছে না।

অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, বাজেট কাটছাঁট করা হলেও খাদ্য ভর্তুকি যেন না কমানো হয় সেটি খেয়াল রাখা হয়েছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারসহ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি হ্রাস করা হবে না যদিও এ খাতে সরকারের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন কর্মসূচি আগামীতে অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কো-অডিন্যান্স কাউন্সিল বৈঠকে। বিশেষ করে ‘থোক বরাদ্দ তহবিল’-এর অর্থ ব্যয়, সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণ, মন্ত্রণালয় ও সংস্থার জন্য যানবাহন ক্রয় বন্ধ রাখার নির্দেশ অব্যাহত থাকবে। বন্ধ থাকবে নতুন স্থাপনা নির্মাণও। অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ, পেট্রোল, অয়েল লুব্রিকেন্ট ও গ্যাস-জ্বালানির মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশ ব্যয়ও স্থগিতের আওতায় আনা হয়েছে।

এবিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে প্রবৃদ্ধির হার কম হবে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতির ওপর। আর অর্থনীতি খারাপ হলে সন্তোষজনক হারে রাজস্ব আহরণও কমবে। যে কারণে সরকার বাজেট কাটছাঁট করছে।

তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আহরণ কমলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সরকারের অর্থ ব্যয়ের ওপর। তবে তাৎক্ষণিক ক্ষতি ঠেকাতে কর ফাঁকি কমানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা এনবিআরের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বিগত তিন বছরে করোনার অভিঘাত কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময় বড় ধাক্কা দেয় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার অর্থ ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনের পথ বেছে নিয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)