সাতক্ষীরায় কৃষকনেতা সাইফুল্লাহ লস্কর এর সমাধিস্থলে পুষ্পমাল্য অর্পণ
রঘুনাথ খাঁ:
সমাধিস্থলে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও স্মরণসভার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরায় পালিত হয়েছে বর্ষীয়ান কৃষক নেতা বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি প্রয়াত সাইফুল্লাহ লস্করের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া লস্করপাড়ায় মরহুমের সমাধিস্থলে বৃহষ্পতিবার দুপুর ১২টায় পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। এ সময় প্রয়াতের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন ও শপথ পাঠ করা হয়। শপথ পাঠ করান বিএম শামীমুল হক।
সেখান থেকে একটি শোক মিছিল দুপুর ১টায় শহরের খুলনা রোড মোড়ে পৌঁছায়। সেখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যাপক তাপস বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন, খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক নিবিড় কান্তি বিশ্বাস মিঠু, সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম নেতা আসাবুর রহমান, এনডিএফ খুলনা জেলা সভাপতি আবুল হোসেন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক নাজিউর রহমান নজরুল, এনডিএফ যশোর জেলার সভাপতি আশুতোষ বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি খুলনা জেলা সভাপতি খাদিজা বেগম, পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন জাকির হোসেন লস্কর প্রমুখ। পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক বিএম শামীমুল হক।
সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, সাইফুল্লাহ লস্কর আজীবন শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনগণ ও সাতক্ষীরার ক্ষেত্রে ভূমিহীন গরীব কৃষকদের খাস জমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদনে তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রামের বিকল্প নেই। তখন দেশের কৃষকসহ শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের সমস্যা-সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এখানে কৃষক তার রক্তকে ঘামে পরিণত করে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে জীবন বাজি রেখে ধারদেনার মাধ্যমে উৎপাদন করে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। সার, বীজ, কীটনাশক এবং কৃষিতে আধুনিকায়নের নামে যন্ত্র ও সেচ কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত মূল্যের কারণে উৎপাদন খরচ বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। যা আজ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি নয়া ঔপনিবেশিক আধাসামন্তবাদি দেশ। বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষির সমস্যার মূল কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার এ দেশীয় দালাল আমলা মুৎসুদ্দীপুঁজির নির্মম শোষণ-লুণ্ঠণ। সেই সাথে জোতদার-মহাজনী-সামন্ত শোষণ এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের স্বৈরাচারী শাসন, অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন। বর্তমানে কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, তাঁতিদের অনেকেই নিজ নিজ পেশা পরিবর্তন করে জীবন ধারণ এবং টিকে থাকার সংগ্রামে বিপর্যস্ত। গরীব ভূমিহীন গৃহহীন কৃষকের বছরব্যাপি কাজ না থাকায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে খাল-বিল, নদী-নালা, হাওড় এলাকা সংকুচিত হয়ে পড়া, সাগরে মৎস্য আহরণে প্রয়োজনীয় নৌকা, ট্রলার, জালসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও পুঁজির অভাবে পেশায় টিকে থাকতে মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। মহাজনদের কারসাজি ও দৌরাত্ম্যে উপকূলীয় জেলেদের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের ভাতা লুটপাট, প্রতিবেশি দেশগুলোর বাংলাদেশের সীমানায় বেপরোয়া মৎস্য আহরণ সমস্যাকে গভীর করছে। উপকূলে পর্যাপ্ত লবণ চাষের সুযোগ থাকলেও লবণ চাষীরা লবণের ন্যায্যমূল্য পায় না। এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) বাস্তবায়নে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে গ্রামাঞ্চলের সাথে শহরের যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর নামে সাম্রাজ্যবাদি লগ্নিপুঁজির গ্রামাঞ্চলে বিনিয়োগের রাস্তকা প্রশস্ত করা হয়েছে। এভাবে সামন্তবাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ আরও পোক্ত করা হয়েছে।
কৃষক ও কৃষির জন্য অপরিহার্য হচ্ছে সেচ ব্যবস্থা। হিমালয় বিধৌত উপমহাদেশে ভৌগলিক কারণে স্বাভাবিক নিয়মে এই পানির প্রায় ৮০ ভাগ প্রবাহিত হয়ে থাকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানের দেশ ভারত আন্তজার্তিক নদী আইন অস্বীকার করে একতরফাভাবে বাঁধ, ব্যারেজ, ড্যাম, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মাণ করে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভারত সরকারের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদের দেশে উষর ভূমিকে চাষোপযোগি করে আমাদের দেশে মরুময়তার সৃষ্টি করছে। যা আমাদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের এই ভয়ঙ্কর ভূমিকা শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে বাংলাদেশের জন্য কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিককালে প্রতিবছর সিলেট বিভাগে পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চলতিবছর সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা এবং যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরায় ব্যাপক এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতায় জনজীবনকে এবং এদেশের কৃষক ও কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচন্ড আঘাত হেনেছে। তাছাড়া পাকিস্তান আমলে মার্কিন পরিকল্পনায় ওয়াপদার ধারাবহিকতায় বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত প্রকল্পসমূহ উপকূল অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সমস্যা, ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় এতদঞ্চলের কৃষক জনগণকে ধারাবাহিক দুর্ভোগের শিকারে পরিণত করেছে। এ সকল সমস্যার আশু সমাধানে প্রয়োজন নদ-নদী, খাল-বিল খনন, উজানের দেশ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, অপরিকল্পিত স্থাপনা উচ্ছেদ ইত্যাদি সমন্বিত করে জাতীয় সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। অন্যদিকে স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন কৃষি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল সংযোগ সেতু এবং প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের সংযোগকারী মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরীয় দেশ। এখানকার আধিপত্য নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দিতা সুতীব্র। বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বণ্টন নিয়ে আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ সংঘাতে রূপ নিয়ে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, প্যালেস্টাইনে মার্কিন ও পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট ইসরাইলের আগ্রাসন ও বেপরোয়া গণহত্যাসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার বিপদ, তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরকে কেন্দ্র করে মার্কিন ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ উন্মাদনা। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারসহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদকে বাড়িয়ে চলেছে। এই যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য এবং সাম্রাজ্যবাদী চীন-রাশিয়া স্ব-স্ব পক্ষে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করতে সর্বাত্মক স্বচেষ্ট। এমন এক প্রেক্ষাপটে এতদঞ্চলের প্রধান আঞ্চলিক শক্তি নয়াঔপনিবেশিক ভারতকে নিয়ে উভয় পক্ষের তৎপরতা লক্ষণীয়, তেমনি বাংলাদেশকে নিয়ে সাম্রজ্যবাদী পরিকল্পনা মূর্ত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে মার্কিন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা সরকারের অকার্যকারিতা এবং প্রতিপক্ষ চীনের নেতৃত্বে বিআরআই এবং চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে ব্রিকস, এসসিও প্রক্রিয়াতে যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে মার্কিন পরিকল্পনায় দালাল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতার এই পালা বদলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক দালালের পরিবর্তে আর এক দালাল ক্ষমতাসীনরা সংস্কারের যে কথা বলছে তাতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রেখে অগ্রসর ও দীর্ঘস্থায়ী করার অপতৎপরতা ছাড়া আর কিছু না। এতে ছাত্র,শ্রমিক, শ্রমজীবি, পেশাজীবিদের সমস্যার যেমন সমাধান হবে না, তেমনি কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন তো দূরের কথা সংস্কারও হবে না। তাই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণের জরুরী দাবি-দাওয়া নিয়ে চলমান আন্দোলনকে সর্বাত্মক রূপ দিতে হবে। সাইফুল্লাহ লস্কর-এর রেখে যাওয়া পথে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে কৃষি বিপ্লব তথা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে আপসহীন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে।