অবৈধ ইটভাটার ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে জীবন ও পরিবেশ
আব্দুর রহমান :সাতক্ষীরা জেলার প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের স্বাস্থ্যকে গ্রাস করছে বেআইনিভাবে পরিচালিত অসংখ্য ইটভাটা। আইন এবং উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও প্রভাবশালী ইটভাটা মালিকেরা অবাধে ইট পোড়ানোর জন্য কাঠ, তুষকাঠ এবং টায়ার পোড়ানোর মতো পরিবেশবিধ্বংসী জ্বালানি ব্যবহার করছেন। এই সব ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলছে, যা একদিকে গাছপালা ধ্বংস করছে, অন্যদিকে এলাকাবাসীর ফুসফুসে ঢুকছে ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি।
সাতক্ষীরা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ‘সাতক্ষীরায় মোট ৯৬টি ইটভাটার মধ্যে ৮৩টি ঝিকঝাক পদ্ধতির এবং ১৩টি সনাতনী পদ্ধতির ভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৭টি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ছাড়পত্রবিহীন এসব অবৈধ ইটভাটার কোনো সরকারি লাইসেন্সও নেই। শুধু উচ্চ আদালতে একটি রিটের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর এসব ইটভাটা অবৈধভাবে পরিচালনা করছেন ভাটামালিকরা।সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের নুনগোলা এলাকায় মেসার্স এমআরএস ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা বেতনা নদীর চর দখল করে গড়ে উঠেছে। এই ভাটায় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ভাটার চারপাশে স্তুপ আকারে জ্বালানি কাঠের মজুত দেখা গেছে এবং প্রবেশমুখে তুষকাঠও সাজানো রয়েছে। জনবসতি এলাকায় অবস্থিত এই ভাটায় কাঠ ও তুষকাঠ পোড়ানোর ফলে যে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে, তা বায়ু দূষণ করে স্থানীয়দের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এছাড়া, সাতক্ষীরা সদরের গাভা ফিংড়ী এলাকার রাহাত ব্রিকসসহ বিনেরপোতা এলাকার হাবিব ব্রিকস, এসবিএফ ব্রিকস, সাদিয়া ব্রিকস, বিবি ব্রিকস, এসএলবি ব্রিকস, হাওয়ালখালির রাকিন ব্রিকস, ভাদড়া মোড়ের কেএন ব্রিকসসহ আরও অনেক ইটভাটায় কয়লার সঙ্গে কাঠ ও তুষকাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। আশাশুনি উপজেলার হাজী ব্রিকস, গুণাকরকাটির রুমানা ব্রিকস, সরদার ব্রিকস, কালিগঞ্জ উপজেলার একতা ব্রিকস, উজিরপুরের টিআরবি ব্রিকস, বাজারগ্রামের শেখ ব্রিকস, ময়না ব্রিকস, চন্ডিপুরের এস বি-১৭ ব্রিকস, শ্যামনগরের এবিআর ব্রিকস, সোনারমোড়ের এইচ.বি ব্রিকস ও আশা ব্রিকস, খানপুরের গাজী ব্রিকসসহ জেলার শতাধিক ভাটায় এই অনিয়ন্ত্রিত জ্বালানি ব্যবহারের ফলে আশপাশের মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটাগুলোর আশেপাশে থাকা গাছপালা যেন ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। কৃষকের ফসল, ফলের বাগান, এমনকি বাড়ির উঠানের সবুজ ঘাসও এই বিষাক্ত কালির আঘাতে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই গাছগুলোই ছিল সাতক্ষীরার মাটি, পানি, বাতাসের বিশুদ্ধতার প্রতীক।ইটভাটা মালিকেরা যুক্তি দেন, কয়লার দাম বেড়ে গেছে, তাই কাঠের মিশ্রণ ছাড়া ইট পোড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই যুক্তি এলাকার শিশু ও বৃদ্ধদের বিষাক্ত বাতাসে শ্বাসকষ্টের পেছনের কারণ হতে পারে না। এদের কেউ কেউ তো সারা জীবনেও শহরের বিশুদ্ধ বাতাসের স্বাদ পাননি, অথচ বিষাক্ত ধোঁয়ায় তাদের ফুসফুসের শুদ্ধতা দিন দিন হারাচ্ছে।বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে যখন দেখা যাচ্ছে, সাতক্ষীরা জেলার প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও, ইটভাটা মালিকরা একরকমের আইন অবজ্ঞা করে অবৈধভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বহুবার এসব ইটভাটা বন্ধের দাবিতে আওয়াজ তুলেছে, কিন্তু আদালতের রিটের বাধার কারণে তাদের চেষ্টাও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।অথচ, প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি শুধুমাত্র গাছপালা বা প্রাণীদের ওপরই পড়ে না, এই প্রভাব পরোক্ষভাবে মানুষের জীবনেও আঘাত হানে। যেসব ইটভাটা থেকে বায়ুতে নির্গত হচ্ছে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ধোঁয়া, তা শুধু এলাকার জল, মাটি বা উদ্ভিদের ক্ষতি করছে না—ক্ষতি করছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনযাত্রা, তাদের সুস্থতা। এই অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো একদিন সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী প্রকৃতি ধোঁয়ার কুয়াশায় হারিয়ে যাবে।
সাতক্ষীরায় এমন অনিয়ন্ত্রিত ইটভাটা ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হলে, প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ। প্রশাসনের উচিত স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনা করে অবিলম্বে এসব ইটভাটা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তদুপরি, ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধ্য করতে পারলে আমাদের ফসলি জমি, খাল-বিল ও মানুষের জীবন আবারো নিরাপদ হয়ে উঠবে। আমাদের জন্য এখন সময় এসেছে দায়িত্বশীল হওয়ার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে একটি সম্মিলিত সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা ছাড়া সাতক্ষীরার ধোঁয়ার চাদর থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। তাহলে, হয়তো আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য আবার একটি সবুজ সাতক্ষীরার স্বপ্ন দেখতে পারবে -যেখানে প্রতিটি নি:শ্বাস হবে মুক্ত, বিশুদ্ধ এবং জীবনমুখী।