হুন্ডি বন্ধ হলেই রেমিট্যান্সে আসবে জোয়ার

অনলাইন ডেস্ক:

বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন, তার অন্তত ৯০ শতাংশ বৈধ পথে আনতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহে জোয়ার সৃষ্টি হবে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ও রিজার্ভ ইতিবাচক ধারায় ফিরবে। তথ্য মতে, ব্যাংকিং চ্যানেলে বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২১ টাকা পাচ্ছেন প্রবাসীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় অংকই পাচার হয়ে যাচ্ছে। যার বার্ষিক অংক অন্তত ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রবাসীদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্ধেকই পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সরকারি কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কিংবা লিখিত হিসাব নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানো সময়সাপেক্ষ হলেও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পাচার বন্ধ করে রেমিট্যান্সে জোয়ার সৃষ্টি করা সম্ভব। এতে চলমান ডলার সংকট ও বিজার্ভের পতন ত্বরিত গতিতে নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সরকারের বিভিন্ন দফতর, বিদেশে অবস্থানরত দূতাবাস এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

এর আগে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছিল প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণের সুপারিশও করেছে ওই কমিটি।

কমিটির বৈঠকে বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ১০টি প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়। কারণগুলো হলো- বৈধ পথের তুলনায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্সে বিনিময় হারের বেশ ফারাক, প্রবাসী কর্মীর বৈধ কাগজপত্র না থাকা, প্রবাসে বাংলাদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা না থাকা বা পর্যাপ্ত শাখার অভাব। এ ছাড়া বাংলাদেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান না থাকা বা পর্যাপ্ত মানি এক্সচেঞ্জ পয়েন্ট না থাকা, রেমিট্যান্স প্রেরণে উচ্চ ফি বা সার্ভিস চার্জ এবং নির্ধারিত সীমা (সিলিং), হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের বা প্রবাসীদের নিকটাত্মীয়দের দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না, আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রতিবন্ধকতা, অননুমোদিত ব্যবসা বা কাজের আয় বৈধ পথে প্রেরণের সুযোগ না থাকা, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে সচেতনতা ও উৎসাহের অভাব।

একই বৈঠকে বিদেশগামী জনবলকে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণ প্রাপ্তিতে সহায়তা এবং বিদেশে শ্রমিক মৃত্যুজনিত সমস্যা নিরসনের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। সেইসঙ্গে বিদেশে জনশক্তি প্রেরণে নতুন নতুন শ্রমবাজার অন্বেষণ ও অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্বের সব শ্রম চাহিদার দেশে যুক্তিসংগত বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিনা অভিবাসন ব্যয়ে জনশক্তি পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণেরও অনুরোধ করা হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনায় উঠেপড়ে লাগতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে আরো তৎপরতা দেখাতে হবে। এ কাজে কিছু দেশের মতো বিশ্বব্যাংকেরও সহায়তা নেয়া যেতে পারে। হুন্ডিকে চতুরভাবে উৎসাহিত করার কাজে যুক্ত কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বা তাদের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। রফতানি আয় দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ বাজারে সব উপায়ে ডলারের জোগান বাড়াতে হবে আরো বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অবৈধ হুন্ডি বন্ধ হলে রেমিট্যান্স অনেক বাড়বে। তবে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিংসহ যেসব মাধ্যমে মুদ্রা পাচার হয় সেগুলো নির্ণয় করতে হবে। এর সুবিধাভোগী কারা এবং কাদের সহায়তায় এটি হয়, তা খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। তাই দক্ষ জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে প্রবাসী বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি বর্তমানে যারা বিদেশে আছেন তাদের বৈধ পথে নিয়ে আসতে হবে। যেসব ভোগান্তি আছে তা সমাধান করতে হবে।

গত বছরের শেষ দিকে অর্থ পাচারের নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউরোপের দেশ পর্তুগালে অর্থ পাচারের ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের আড়াই হাজার নাগরিকের একটি বিশাল চক্র। নিরাপদে অর্থ সরিয়ে নিতে তারা দেশটির নাগরিকত্বও নিয়েছে। এরমধ্যে দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। বর্তমানে অর্থ পাচারের প্রধান রুট হিসেবে দেশটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচারকার্য পরিচালনার জন্য দুবাইয়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান খুলেছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অর্থ পাচারের বাহক হিসেবে কাজ করছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে আমদানি-রফতানির আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে কয়েকটি শিল্পগ্রুপ।

রেমিট্যান্স প্রবাহ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসে ২১১ কোটি ডলার, ফেব্রুয়া‌রি‌তে ২১৬ কো‌টি ডলার, মার্চ মাসে আসে ১৯৯ কোটি ডলার, এপ্রিলে ২০৪ কোটি ডলার, মে মাসে ২২৫ কোটি ডলার, জুনে ২৫৪ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ডলার এবং গত আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ডলার।

তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসে ২ হাজার ৩৯২ কোটি ডলার। তার আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার, যা ছিল অর্থবছর হিসাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স। তবে এর আগের অর্থবছর ২০১৯-২০-এ এসেছিল মাত্র ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)