প্রাথমিক-মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ

অনলাইন ডেস্ক:

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পদত্যাগের পর থেকেই সরকারের বিভিন্ন দফতরে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। বাদ যাচ্ছে না প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো। তবে অনেক জায়গায় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বুধবার (২৮ আগস্ট) দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজন শিক্ষককে জোরপূর্ব পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অপসারণে মানববন্ধন ও পদত্যাগের চিত্র তুলে ধরা হলো-

সরিষাবাড়ীতে প্রধান শিক্ষকের অপসারণ দাবি:

দুর্নীতির অভিযোগ এনে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় এক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার (২৮ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত উপজেলার সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধন করেন।

জানা যায়, সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়াজেদা পারভীনের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগে দুপুরে ওই প্রধান শিক্ষকের তার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ৮ম শ্রেণির ছাত্রী মোছা. মহিমা নেতৃত্ব এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেন।

সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রধান শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরেই স্কুলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে আসছিলেন। এখন সরকার পরিবর্তনের ফলে তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে।

বকশীগঞ্জে ছাত্রদলের নেতৃত্বে জোরপূর্বক প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ:

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় দুই ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে জোরপূর্বক এক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগের খবর পাওয়া গেছে। দুপুর ১টার দিকে উপজেলার নিলক্ষিয়া রূপজাহান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুজা মিয়ার সঙ্গে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় (বহিরাগত) বকশীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক রাসেল সরকার এবং বকশীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বাইজিদ আলামিন উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, দুপুর ১টার দিকে নিলক্ষিয়া রূপজাহান পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী, স্থানীয় জনগণ ও বহিরাগত ১০০-১২০ জন মানুষ উপস্থিত হয়ে প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করেন। এ সময় ছাত্রদলের দুই নেতা রাসেল সরকার ও বাইজিদ আলামিনের নেতৃত্বে জোরপূর্বক প্রধান শিক্ষক সুজা মিয়াকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান বলে জানা যায়।

অভিযোগ রয়েছে, নিলক্ষিয়া রূপজাহান পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক সুজা মিয়া বিগত সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত।

টঙ্গীতে তোপের মুখে পদত্যাগ করলেন প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষিকা:

টঙ্গীর আরিচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তোপের মুখে পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রধান শিক্ষিকা সুলতানা রাজিয়া।

সুলতানা রাজিয়া স্কুলে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে প্রবেশ করতে দেননি এলাকাবাসী। এর আগে, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ও গাজীপুর জেলা শিক্ষা অফিসে বিক্ষোভ করেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অবিভাবক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষাকা সুলতানা রাজিয়া তোপের মুখে পরে জেলা শিক্ষা অফিসার মো. মাসুদ ভূঁইয়ার কাছে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দেন।

পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমি পদত্যাগ করলাম।’

কোটালীপাড়ায় দুই শিক্ষকের পদত্যাগ দাবিতে মানববন্ধন:

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় পিঞ্জুরী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন।

বেলা ১১টার দিকে বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে তারা এ মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রধান শিক্ষক নীহার রঞ্জন বারুরী ও কম্পিউটার শিক্ষক মিঠু মন্ডল ক্লাসের ছাত্রীদের দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করে আসছেন। এ ব্যাপারে সাবেক ম্যানেজিং কমিটিসহ শিক্ষা দফতরে অভিযোগ করেও আমরা কোনো প্রতিকার পাইনি। তাই যৌন নিপীড়নকারী ঐ দুই শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করছি। আমরা অনতিবিলম্বে তাদের অপসারণ চাই।

গোপালগঞ্জ জেলার সহ-শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। জেলা শিক্ষা অফিসারকে বিষয়টি তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হবে।

বিরামপুরে মাদরাসা সুপারের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন:

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বিনাইল ইউনিয়নের পুইনন্দা আলিমিয়া দাখিল মাদরাসার সুপারের পদত্যাগ দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী।

বেলা ১১টার দিকে মাদরাসায় ও পরে উপজেলা পরিষদের সামনে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মাদরাসার সুপার শহিদুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নুজহাত তাসনীম আওনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। মানবন্ধনে এলাকাবাসীর পক্ষে বক্তব্য দেন জহুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, মাদরাসা সুপার শহিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দুর্নীতি করে আসছেন। তিনি অশ্লীলতা, দুর্নীতি, দখলবাজ, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও মাদরাসার ৪ একর ৭০ শতক জমির ফসল দীর্ঘদিন ধরে আত্মসাৎ করে আসছেন।

হিলিতে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ দাবিতে সংবাদ সম্মেলন:

দিনাজপুরের হিলিতে বাংলাহিলি পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা কামালের পদত্যাগের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন হিলির বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।

দুপুরে হাকিমপুর প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা তাদের লিখিত বক্তব্যে জানান, বাংলাহিলি পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা কামাল প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের মতো নানান অনিয়ম করেছেন।

এ সময় সকল প্রকার দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্ব্যবহারের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও কলঙ্কমুক্ত করতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।

মাদারীপুরে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ:

মাদারীপুরের শিবচরের চর কামারকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমএ বারেক মিয়ার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। দুপুরে বিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন তারা। বিক্ষোভের মুখে ওই শিক্ষক বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, সম্প্রতি বিদ্যালয়ের আয়া পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আড়াই লাখ টাকা নিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক। অথচ চাকরি দেননি, টাকাও ফেরত দেননি। এ ছাড়াও অন্যান্য পদে এর আগেও টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ৫ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। এ ছাড়াও ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে তিনি এ পর্যন্ত লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিদ্যালয় থেকে। শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট বাবদ টাকা রাখতেন। টাকা ছাড়া সার্টিফিকেট দিতেন না।

জয়পুরহাটে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ:

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা দ্বি-মূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের পক্ষে বিপক্ষে আন্দোলন করেছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। এতে শিক্ষকের বিপক্ষে ছাত্ররা আর পক্ষে ছাত্রীরা পাল্টা-পাল্টি বিক্ষোভ করেছেন।

দুপুরে বাগজানা দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ক্লাস বর্জন করে ছাত্ররা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইমদাদুল হকের নানা অনিয়ম তুলে ধরে তার পদত্যাগের দাবি করেন।

অন্যদিকে, প্রধান শিক্ষকের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রধান শিক্ষকের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘটনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এক বৈঠক বসে আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফেরেন।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালাকালীন সময়ে বাগজানা দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইমদাদুল হক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন।

বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গেও খারাপ আচারণ করেন। আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন। আগে আমাদের স্কুলে শিক্ষার মান ভালো ছিল কিন্তু এই প্রধান শিক্ষক আসার পর থেকে স্কুলের শিক্ষার মান আর আগের মতো নেই। এছাড়া বেশ কিছু অনিয়ম আছে তার। আমরা তার পদত্যাগ চাই।

অপরদিকে, প্রধান শিক্ষকের পক্ষে অবস্থান করা ছাত্রীরা বলেন, আমাদের প্রধান শিক্ষক স্যার স্কুলের আসার পর পড়াশোনার মান উন্নয়ন ও বিদ্যালয়ের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা স্যারের পক্ষে আছি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)