দেবহাটার খলিষাখালির ভূমিহীনদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গুলিবিদ্ধ-১সহ জখম ১৫

রঘুনাথ খাঁ ঃ সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিষাখালি ও নোড়ার চক ভ‚মিহীন জনপদে ভ‚মিদস্যু ও তাদের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা মুহু মুহু গুলি ও বোমা ছুঁড়ে হামলা চালিয়েছে। এ সময় খলিষাখালি, নোড়ার চক ও বাঁশিরামপুরের কমপক্ষে ২০টি বাড়ি, ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পিটিয়ে, কুপিয়ে ও গুলি করে জখম হয়েছেন কমপক্ষে ১৫ জন। আহত চারজনকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া ও মামলার না করার জন্য জোরপূর্বক মুচলেকায় সাক্ষর নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার সকাল সোয়া ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ হামলা অব্যহত রাখা হয়। গুরুতর আহত সাতজনকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নোড়ারচক গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে মনিরুল ইসলাম(৩৯) জানান , নলতার বিএনপি নেতা ও চেয়ারনম্যান আরিজুল ইসলাম, মাছ আনারুল, আদালতে স্বর্তহারানো জমির মালিক দেবহাটার সখীপুরের আইডিয়ালের পরিচালক ডাঃ নজরুল, শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, পারুলিয়ার আনারুল ইসলাম, রেজাউল ইসলামসহ কয়েকজন সম্মিলিতভাবে খলিষাখালি থেকে ভ‚মিহীনদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেন। পারুলিয়ার নূর আমিন তার জামাতাকে দিয়ে সেনাসদস্যদের হামলাকারিদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেও তা ধোপে টেকেনি। একপর্যায়ে নলতা চেয়ারম্যানের অফিস চত্বরে তারা কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগর, ইন্দ্রনগর, তালার মাছিয়াড়া , দেবহাটার নাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের নিয়ে বৃহষ্পতিবার বৈঠক করা হয়। সে অনুযায়ি বিএনপি নেতা আরিজুল ইসলাম ও আনারুলের(মাছ) নির্দেশনায় নলতা, কাজলা, কাশিবাটি, বৈরাগীর চক, চিংড়িখালি, সখীপুর, পারুলিয়া, পলগাদা, নোড়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ মানুষ ও ভ‚মিহীনদের উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে শুক্রবার সকালে সোয়া ১১টার দিকে বাবুরাবাদ, পারুলিয়া জেলেপাড়া ও গাজীরহাট থেকে দেড় থেকে দুই হাজার সশস্ত্র লোক সন্ত্রাসী কায়দায় পাইপগান, পিস্তল, সটগান, বোমা নিয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ করে। তাদের মুহু মুহু গুলি ও বোমার শব্দে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নলতায় আরিজুল ইসলাম ও আনারুল (মাছ), গাজীরহাটে সুরুজ কাজী ও রেজাউল চেয়ারম্যান, পারুলিয়া বাসস্টাÐে আইডিয়ালের নজরুল, রেজাউল, ফরিদ মোল্লা, আনারুল অবস্থান নিয়ে হামলার নির্দেশনা দেন। তালার মাছিহারার রুহুল আমিনের ছেলে পাখরা হালিম, দেবহাটার নাংলার গফুর, চিংড়িখালির শহীদুল, রবিউল (বুল্লা), কাশিবাটি ও ইন্দ্রনগরের সেকেন্দার, শওকত, মুর্শিদ, চালতেতলার নূর আলী, নূর আলীর ভাই আদর অলী, সদরের এল্লার চরের সেন্টুর ছেলে আব্বাস, কৃষ্ণনগরের ইয়ার আলী, বাহার আলী, জহুর আলীসহ কমপক্ষে ১৫ জন বন্দুক, সটগান, পিস্তল ও বোমা নিয়ে হামলার নেতৃত্বে দেয়। পারুলিয়ায় খলিষাখালিতে বসবাসরত ভ‚মিহীনরা পালানোর চেষ্টা করলে হামলাকারিদের সট গানের গুলি তার পিঠের বাম পাজরে বিদ্ধ হয়।
নোড়ার বাসিন্দা রিপন হোসেন জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হামলাকারিরা আসছে জেনে পরিবারের সকল সদস্যরা পালিয়ে যান। এ সময় সন্ত্রাসী পাখরা হালিমের নেতুত্বে পার্শ্ববর্তী আব্দুল্লাহর বাড়ি থেকে তার বাবা বৃদ্ধ আবুল হোসেনকে ধরে আনেন। এরপর লোহার রড দিয়ে তার বাবার ডান হাত দুই জায়গায় ভেঙে দেওয়া হয়। ফাটিয়ে দেওয়া হয় তার মাথা। এরপরপরই হামলাকারিরা তার, বাবার ও ভাই রাজুর বাড়ির সর্বস্ব লুটপাট করে ভাঙচুরের পর আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে তার বাবা, খলিষাখালি চরপাটার আইয়ুব আলীর ছেলে রবিউল, হামিজউদ্দিনের ছেলে জব্বার, আনিসুরের ছেলে আবু সাঈদকে তুলে নিয়ে আরিজুলের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে চারজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাবকে নলতা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এক্স-রে করার পর ডান হাতের দুই জায়গায় ভেঙে গেছে বলে প্লাস্তার করা হয়।
সাতক্ষীরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সখীপুর ইউনিয়নের খাড়য়াডাঙা গ্রামের প্রসাদ মÐলের ছেলে মহাদেব মÐল জানান, মামাত ভাই আকাশ ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছে এমন কথা জেনে তিনি গত ১৮ আগষ্ট নোড়া গ্রামের মামার বাড়িতে যান। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সন্ত্রাসীরা মামার বাড়িতে ঢুকে তার দুই পায়ে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে ও মাথা লোহার রড দিয়ে জখম করে। এরপরপরই মামা মেঘনাদ বাউলিয়া ও দয়াল বাউলিয়াকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করা হয়। হামলায় জখম হন পার্শ্ববর্তী বিমল বিশ্বাসের ছেলে শম্ভুনাথ বিশ্বাস ও অমূল্য মÐলের ছেলে শান্তনু মÐল। ওই সব বাড়ি থেকে লুটপাট করা হয়। তাদেরকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
খলিষাখালির আবু বক্করের ছেলে কামরুল ইসলাম জানান, হামলাকারিরা তার ও তার ভাই যথাক্রমে নোড়া মসজিদের মোয়াজ্জেম মিজানুর রহমান ও আরিফুল ইসলামের বাড়িঘর, চরপাটার শফির দোকান, রিয়াজ আহম্মেদ এর বাড়ি, হাসান সরদারের বাড়ি, আশাশুনির বাঁশীরামপুরের হাজরা বিবি, তার পার্শ্ববর্তী তিনটি হিন্দু বাড়ি, শাহজাহানের বাড়ি, চালতেতলার গোলাপ ঢালীসহ কমপক্ষে ২০টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলায় খলিষাখালিও নোড়ার একজন গুলিতে ছাড়াও ১৪ জনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। অনেকেই এলাকায় বসবাসের স্বার্থে মামলা করা তো দূরের কথা,গোপনে হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাতক্ষীরার একজন লড়াকু নেতা মিজানুর রহমান জানান, খলিশাখালির উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে তিনিসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতা সম্প্রতি পুলিশ সুপার ও সাতক্ষীরার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। শুক্রবার দুপুর একটার দিকে তারা দেবহাটা সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মোঃ ফজলুলর হক ও দেবহাটা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুস সালামের সাথে কথা বলেছেন। এরপরও বিএনপি নেতা আরিজুল ইসলামসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ভ‚মিহীনদের বাড়িতে হামলা , ভাঙচুর ও লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ, গুলি করে ও কুপিয়ে জখম করারর বিষয়টি তাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ অবস্থার উত্তরন ঘটাতে তারা সাধ্যমত চেষ্টা চালাবেন।
এ ব্যাপারে নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আরিজুল ইসলামের কাছে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৯ মিনিটে তার কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি রিসিভ করেননি।
দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুস সালাম জানান, এ ঘটনায় ভ‚মিহীনদের পক্ষ থেকে কোন লিখিত অভিযোগ করা হয়নি। আন্দোলনকারি ছাত্র নেতারা তার কাছে শুক্রবার আসার কথা নিশ্চিত করে জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশের কি বা করার আছে?

প্রসঙ্গতঃ ১৯৫৫ সালে চÐিচরণ ঘোষসহ কয়েকজনের ফেলে যাওয়া ১৩১৮ বিঘা জমি লাওয়ারিশ হিসেবে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ২০২১ সালের ২৬ জুলাই ঘোষণা করে। একপর্যায়ে সাপমারা খাল খননকালে দুই পার থেকে উচ্ছেদ হওয়া কয়েকশত ভ‚মিহীনসহ প্রায় ৮০০ ভ‚মিহীন পরিবার ওই জমিতে ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে বসবাস শুরু করে। এতে ক্ষুব্ধ ছিল জালজালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরিকারি শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, সখীপুরের আব্দুল আজিজ, বেসরকারি সংস্থা আইডিয়ালের নির্বাহী পরিচালক ডাঃ নজরুল ইসলাম, আহছানিয়া মিশনের কর্মকর্তা ইকবাল মাসুদসহ কমপক্ষে শতাধিক ভ‚মিদস্যু। একপর্যায়ে তারা পুলিশকে ব্যবহার করে ভ‚মিহীনদের নামে কমপক্ষে ১৯টি মামলা দেয়। এ ছাড়াও ভ‚মিহীনদের আদালত, রাস্তা ও বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্যাতনের পর মাদক ও অস্ত্র দিয়ে চালান দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর ভ‚মি সংক্রান্ত এক বিশেষ সভায় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবীর বিশেষ সুবিধা নিয়ে ওই জমি মালিকপক্ষের বলে সিদ্ধান্ত নিলে কথিত ওই জমির মালিকরা ১৩ বছর যাবৎ বন্ধ থাকা খাজনা সুদসহ পরিশোধ করেন। এরপররই ভ‚মিহীনদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হলে তা রদ করতে ভ‚মিহীন নেতা আনারুল ইসলাম ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি হাইকোর্টে ১৫০০/২২ নং রিট পিটিশন দাখিল করেন। ওই বছরের ২৭ ফেব্রয়ারি হাইকোর্ট ওই জমিতে যে যে অবস্থায় আছে তা বজায় রাখার আদেশ (স্টাটাসকো) দেন। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টে স্বত্বহীন হওয়া ৩৬ জন কথিত জমির মালিক রেসপন্ডডেন্ট হিসেবে ওই মামলায় অর্ন্তভ‚ক্ত হন। ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পুলিশ কম পাঠিয়ে তৎকালিন পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান কথিত জমির মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে শতাধিক পুলিশ পাঠিয়ে ওইসব স্বর্তহীন জমির মালিকও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীকে সহযোগিতা করে হাইকোর্টে স্থিতাবস্থা থাকা জমি থেকে ৭৮৫টি ভ‚মিহীন পরিবারের ঘরবাড়িতে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত করেন। পরবর্তীতে সূযোগ বুঝে ভ‚মিহীনরা আবারো ওই জমিতে বসবাস শুরু করে। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ কথিত জমির মালিকদের করা সিভিল রিভিউ পিটিশন (১৬৮/২১) খারিজ করে দেন। এহেন পরিস্থিতিতে স্বর্তহীন হওয়া মালিকদের কয়েকজন নলতার বিএনপি নেতা আরিজুল ইসলাম, আনারুল ইসলাম (মাছ), মিলন বাবু, নওয়াপাড়ার রেজাউল ইসলাম, পারুলিয়ার গোলাম ফারুক বাবু, ইলতুতসহ কয়েকজনের কাছে ভ‚মিহীনদের কাছে মাছ বিক্রি সংক্রান্ত একটি চুক্তিপত্র করে দেয়। ওই জমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই মাছ ভ‚মিহীনদের মাধ্যমে নিজের বা পছন্দের সেটে কিনতে টাকা বিনিয়োগ করেন আরিজুল, ইলতুত, গোলাম ফারুক বাবু, রেজাউলসহ কয়েকজন। তারা উচ্ছেদ হওয়া ভ‚মিহীনদের একটি গ্রæপকে কাজ লাগিয়ে খলিষাখালিতে অবস্থান নেওয়া ভ‚মিহীনদের উচ্ছেদের পায়তারা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ আগষ্ট ভ‚মিহীনদের উপর হামলা চালানো হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয় আল আমিন। পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয় সাইফুলসহ চারজনকে। একপর্যায়ে ভ‚মিহীনদের কঠোর অবস্থানের কারণে হামলাকারিরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। হামলা ও পরবর্তীতে আবারো হামলার আশঙ্কার বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারি কয়েকজনকে নিয়ে সাতক্ষীরা সেনা ক্যাম্প ও পুলিশ সুপারকে অবহিত করা হয়। এরপরও ভ‚মিদস্যুদের পক্ষ থেকে আটশত বিঘার শওকত হোসেন, কালিগঞ্জের নওয়াপাড়ার ফজলুর রহমান ও দেবহাটার রামনাথপুরের আলীম গাইন ভ‚মিহীনদের নামে ১৯ আগষ্ট দেবহাটা থানায় তিনটি পরিকল্পিত মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)