ভোমরা বন্দর সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের অবৈধ দখল কমিটির নেতারা আত্মগোপনে, ব্যবসায় গতি আনতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন
মনিরুল ইসলাম মনি :সাতক্ষীরায় ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা গাঢাকা দিয়েছেন। ফলে ভোমরা স্থল বন্দরের ব্যবসা-বানিজ্যের কার্যক্রমে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। প্রায় দুই কোটি টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকার দলীয় এমপি এবং তৎকালিন পুলিশ সুপার কোন ভোট না দিয়ে জোরপুর্বক অবৈধ ভাবে ভোমরা ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি করে দেন। কমিটির সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লগি নেতা কাজী নওশাদ দেলোয়ার রাজু ও সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান। ৯ সদস্যের এই কমিটি ২০২২ সালে দায়িত্ব নিয়ে সাতক্ষীরা ভোমরা স্থল বন্দরের ব্যবসায়ীদের একপ্রকার জিম্মি করে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাদের নগদে খুশি রেখে বন্দরে গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও পুলিশ-প্রশাসনের ভয় ও আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের হুমকি ধামকিতে কোন ব্যবসায়ী মুখ খুলতে সাহস পাননি। ভারত থেকে আমদানিকৃত গাড়ি প্রতি ভারতীয় দুই’শ রুপি চাঁদা আদায় করাসহ নানানভাবে হয়রানি করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দফায় দফায় চাঁদা আদায় করা হয়েছে। প্রতি মাসে আদায়ের কোটি টাকার ভাগ দেওয়া হতো প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা ও পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের। এছাড়া, দেশের দূর দূরন্ত থেকে ভোমরা স্থলবন্দরে আসা ব্যবসায়ীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতো। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো মোটা অংকের চাঁদার টাকা। এমনকি চিটাগাং এর এক ব্যবসায়ীকে জিম্মিকরে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানোর ঘটনায় সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খানকে কিছুদিন ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটতে হয়েছে। তবে, গত জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের সাথে সাথেই সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতাকর্মীদের মতো ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাজু ও সম্পাদক মাকসুদ খান আত্মগোপনে রয়েছেন। কমিটির অন্যান্য কর্মকর্তা, সদস্যরাও কার্যালয়ে না আসায় ব্যবসায়ী কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘিœত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সংগঠনের সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ্য হয় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে। মুখ থুবড়ে পড়ে সরকারের রাজস্ব আদায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সাধারণ ব্যবসায়ীরা গত ৭ আগষ্ট বিশেষ এক জরুরি সভার আহ্বান করেন। সভায় ব্যবসায়ীদের সর্বসম্মতিক্রমে ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিবকে আহ্বায়ক ও সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অহিদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী মুন্সী রাইসুল হক টুকু, পারুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু ও ভোমরা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুর রহমান আসাদকে সদস্য করে পাঁচ সদস্যের এই আহবায়ক কমিটি করা হয়। এর পর থেকে বন্দরে আবারও বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক ভাবে চলতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠন গুলো নির্বিঘেœ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এবিষয়ে বন্দরের একাধিক আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা জানান, বন্দরে ব্যবসা-ব্যনিজ্যের গতি ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের সর্বসম্মতিক্রমে গত ৭ আগষ্ট ভোমরা সিএন্ড এফ অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়েছে। আওয়ামী লীগ পুষ্ট বিগত কমিটির নেতারা অ্যাসোসিয়েশনের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়েছেন। তাদের কোনো খোঁজ মিলছে না। তাঁরা বলেন, স্বাধীন গণতান্ত্রিক এই প্রতিষ্ঠানে ২০১৭ সালের পর থেকে আর নির্বাচন হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের মতো আমরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন আওয়ামীলীগের দলীয় করন করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতামতকে উপেক্ষা করে বছরের পর বছর সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ ও তাদের এমপিরা পছন্দের লোক দিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে অ্যাসোসিয়েশন দখল করে বন্দর পরিচালনা করেছেন।সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। মাঝখানে জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এজাজা আহম্মেদ স্বপন যিনি এই জেলা শহরে দরবেশ বাবা বলে পরিচিত। তিনিও দীর্ঘ দিন সংগঠনের টাকা নামে-বেনামে এবং ভূয়া বিল ভাউচার তৈরী করে দফায় দফায় দীর্ঘ দিন ধরে কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তবে এই মূহুর্তে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে এই আহবায়ক কমিটি গঠিত হওয়ার পর বন্দরে যেমন স্বস্তি ফিরেছে তেমনি গতি ফিরে আসতে শুরু করেছে সরকারের রাজস্ব আদায়ে। তবে এই মূর্হুতে একটি অসুভ চক্র বন্দরকে অস্থিতিশিল করতে এই কমিটির বিরুদ্ধে অসুভ পায়তারা ও চক্রান্ত শুরু করেছে।আমদানি-রপ্তানিকারক সাধারণ ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সর্ব শেষ ২০২২ সালে পরিকল্পনামাফিক সাধারণ সভার নামে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করে মনোনয়ন পত্র কিনতে দেয়নি জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, জেলা আওয়ামী লীগের দুই এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। পুলিশকে দিয়ে ও আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা প্রকাশ্যে ভয় দেখিয়ে বন্দরে মহাড়া দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নওশেদ দিলোয়ার রাজু- মাকসুদ খানসহ পছন্দের লোকদের অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি গঠন করে এসোসিয়েশন দখল করে নেয়। আওয়ামীলীগের মদতপুষ্ট এই কমিটির গঠন করতে সে সময় প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় পুলিশ প্রশাসনের অসাধু কিছু কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ ও তাদের এমপি, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের জেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়ে কেনা এই কমিটি দীর্ঘদিন ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ইচ্ছে মতো হয়রানি ও চাঁদাবাজি করেছেন। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী ভোমরা বন্ধর থেকে মূখ ফিরিয়ে বেনাপোলসহ দেশের অন্য বন্দরে চলে গেছেন। ওই পরিস্থিতিতে বর্তমানে ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি সর্ব নিম্নের কোঠায় নেমে এসেছে। ব্যবসা-বানিজ্য না থাকায় সরকারের রাজস্ব আদায় অনেক অংশে কমে যায়। নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, সকল ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, যে সকল ব্যবসায়ীরা অন্য বন্দরে চলে গেছেন তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা ও অ্যাসোসিয়েশনের সকল সদস্যদের নিয়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আওয়ামী লীগ দ্বারা হরণকৃত বাক স্বাধীনতা ও ভোটের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে বর্তমান আহবায়ক কমিটির সকলে কাজ করছে। এবিষয়ে তিনি স্থল বন্দরের ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিকারক এ্যাসোসিয়েশন, শ্রমিক সংগঠন এবং সর্বস্থরের সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন।
এদিকে আত্মগোপনে থাকা অবৈধ নিবার্চন বিহীন দখলি কমিটির সাবেক সভাপতি কাজী নওশাদ দেলোয়ার রাজু ও সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খানের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। এমনকি তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশন চালু হয়। এরপর ২০০২ সালে শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে সরকার ঘোষণা করেন। বন্দরটি কলকাতার কাছাকাছি হওয়ায় দেশের আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দরে ব্যবসা-বানিজ্যে শুরু করেন।