ঝুঁকিতে দেশের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি
নিউজ ডেস্ক:
দেশে দুই বছর ধরে অস্থিতিশীল ডলারের বিনিময় হার। অসন্তোষজনক বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ সহায়তার পরিস্থিতি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল। এর মধ্যেই গত অর্থবছরের শেষ মাসে এসে রফতানির তথ্য সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে গত দুই অর্থবছরে রফতানি আয়ের তথ্য থেকে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে দেশের রফতানি খাত হঠাৎ করেই ঋণাত্মক ধারায় চলে যায়। একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সেখানেও বড় ধরণের আঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে দেশের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি আরো ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বলতে প্রধানত দেশের আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্স, বিদেশি ঋণ, বিনিয়োগ ও সহায়তাকে বোঝায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে রেমিট্যান্স ছাড়া সবকটি খাতই ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) আমদানি কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দেশের আমদানি ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমেছিল।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সর্বশেষ প্রকাশনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের বিষয়ে যেসব পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি মৌলিক বিষয় ছিল যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু গত দুই সপ্তাহের ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে । আমদানি-রফতানিসহ শিল্পের চাকা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ মানুষের দৈনন্দিন চলাচলও বাধাগ্রস্ত হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই বছরের বেশি সময় অস্থিতিশীল থাকার পর ডলারের বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছিল। কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে এখনো একটা ভার্চুয়াল লকডাউন চলছে। হত কয়েকদিনে ব্যবসায়ীরা একটা ই-মেইল পর্যন্ত বিদেশি ক্রেতাদের পাঠাতে পারছিলেন না। অনেক ছোট স্টার্টআপ ও ফ্রিল্যান্সার যাদের তথ্যপ্রযুক্তির ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, তারা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ইন্টারনেট না থাকার প্রভাব সব খাতের ওপরই পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনীতি নিয়ে পূর্বাভাস দিতে হলে আগে নিশ্চিত করতে হবে যে স্বাভাবিক অবস্থা কবে ফিরছে। এ মুহূর্তে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনাটাই মূল চ্যালেঞ্জ।
ক্রিসমাস উপলক্ষে বছরের এই সময়টাতে দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে বড় বড় ক্রয়াদেশ আসে। কিন্তু এক সপ্তাহ পুরো দেশ বর্হিবিশ্ব থেকে একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এতে বিদেশি ক্রেতারা চিন্তা করতে পারেন যে তাদের পণ্য সংগ্রহের বিকল্প উৎস তৈরি করতে হবে। সামনের দিনগুলোয় এটি একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ক্রেতাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে না পারলে রফতানির পরিমাণ বাড়বে না।
আমদানিতে অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে না পারলে অর্থনীতি সমস্যায় পড়বে। এটি দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে আমদানিকারকরা কম টাকার এলসি দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দিয়ে আমদানির প্রবণতা তৈরির শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ইন্টারনেট বন্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দেশে দেশে প্রবাসীদের মধ্যে দেশে টাকা পাঠানো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠাতে পারলে তারা যদি বিকল্প পদ্ধতিতে টাকা পাঠানো শুরু করেন তাহলে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো কমে যাওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে।
গত কয়েক বছর দেশে নিট বৈদেশিক সহায়তা আসার পরিমাণও ক্রমেই কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের নিট বৈদেশিক সহায়তা এসেছিল, যার বেশির ভাগই ঋণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি কমে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারে। সদ্যসমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশে নিট বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ৫ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৫ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারের নিট বৈদেশিক সহায়তা এসেছিল। এক্ষেত্রে নিট বৈদেশিক সহায়তা কমেছে ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আক্তার বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পরিস্থিতি খুবই কঠিন। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গত এক সপ্তাহে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। অর্থনীতি বন্ধ হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয় না। এ রকম একটা অবস্থায় প্রথমে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এরপর আবার নতুন বিদেশী বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করার দিকে মনোযোগী হতে হবে।