একদিনেই চার ফ্ল্যাট কেনেন মতিউরপত্নী লায়লা

নিউজ ডেস্ক:
ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর একদিনেই রাজধানীর মিরপুরে চারটি ফ্ল্যাট কেনেন। মিরপুরের মাজার রোডের পূর্ব কান্দর মৌজায় শেলটেক বিথীকা টাওয়ারে থাকা এ চারটি ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটির আয়তন ১৮১২ বর্গফুট করে। এর সঙ্গে ছিল গ্যারেজের পার্কিং স্পেসও। এছাড়াও রাজধানীর বসুন্ধরায় লায়লা কানিজের নামে রয়েছে আরো তিনটি ফ্ল্যাট। দুদকের এক নথি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দু’দফায় এ চারটি ফ্ল্যাটসহ মতিউর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৩৪.০২ একর জমি ও প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ও ৮টি ফ্ল্যাট সম্প্রতি জব্দের আওতায় এসেছে। গত ৪ জুলাই জব্দ করা হয়- মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে বসুন্ধরার তিনটি ফ্ল্যাট এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর নামে জিগাতলার একটি ফ্ল্যাট। সর্বশেষ ১১ জুলাই জব্দ করা হয় লায়লা কানিজের নামে থাকা মিরপুরের চারটি ফ্ল্যাট।

গতকাল ১১ জুলাই মতিউর পরিবারের সদস্যের নামে থাকা ২৩.৬৭ একর জমি, ব্যাংকে থাকা প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ও ৪টি ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য সম্পত্তি জব্দের (ক্রোক) আদেশ দেন আদালত। এর আগে ৪ জুলাই জব্দ করা হয় ১০.৩৫ একর জমি ও ৪টি ফ্ল্যাট। দু’বারই দুদকের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। দুদকের আবেদনে উল্লেখ করা হয়, মতিউর রহমানের সম্পত্তির অনুসন্ধানকালে জানা যাচ্ছে যে, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন। যেটি করতে পারলে মামলা দায়ের ও বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সকল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তাই, সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর সম্পত্তিসমূহ ক্রোক (জব্দ) করা একান্ত প্রয়োজন।

এ নিয়ে দু’দফায় মোট ৩৪.০২ একর জমি ও রাজধানীতে থাকা আটটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেয়া হলো।

দুই দফায় জব্দ হওয়া স্থাবর সম্পত্তি:
প্রথম দফায় ১০.৩৫ একর ও দ্বিতীয় দফায় ২৩.৬৭ একর জমি জব্দের আওতায় আনা হয়েছে। অর্থ্যাৎ, মোট জব্দ হওয়া জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪.০২ একর বা তিন হাজার চার শত দুই শতাংশ।

এসব জমি বরিশাল, সাভার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও নাটোরের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বলে নথি সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও দুই দফায় জব্দ হওয়া স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- রাজধানীর মিরপুরের চারটি, বসুন্ধরার তিনটি ও জিগাতলার একটি ফ্ল্যাট।

কোথায় কত জমি:

এরমধ্যে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্য ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকার সাভারে ২৬.৬১ শতাংশ, ময়মনসিংহের ভালুকায় ১ হাজার ৬২ শতাংশ বা ১০.৬২ একর জমি, গাজীপুরে ৮৭৫.৯৫ শতাংশ, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় ২৩৬ শতাংশ এবং নাটোরের সিংড়ায় ১৬৬ শতাংশ জমি রয়েছে। এছাড়াও বরিশালে মুলাদী উপজেলায় ১১৪ শতাংশ জমি, নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায় রয়েছে ৯০৪.৯৩ শতাংশ বা ৯.০৫ একর জমি। তাছাড়াও ঢাকার বসুন্ধরায় রয়েছে ১০ কাঠা জমি।

কার নামে কত জমি:

দুই দফায় জব্দ হওয়া জমির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি রয়েছে মতিউরের ভাই এমএ কাইউম হাওলাদারের নামে। মেসার্স গ্লোবাল সুজ লিমিটেডের পক্ষে তার নামে রয়েছে ৮৯২ শতাংশ জমি। এছাড়াও মতিউর-লায়লা দম্পত্তির ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্নবের নামে রয়েছে ৭৯১.৬৮ শতাংশ বা ৭.৯২ একর জমি। এ দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতার নামে পাওয়া গেছে ২৯৫.০৫ শতাংশ বা ২.৯৫ একর জমি। মতিউরের আপন ভুবন শুটিং স্পটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মনোয়ার হোসেনের নামে ১৬৬.৭২ শতাংশ জমি।

এছাড়াও মতিউরের নামে থাকা ২৬৬ শতাংশ ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা ৭৬১.৬৫ শতাংশ বা ৭.৬২ একর জমি রয়েছে জব্দের তালিকায়। এদিকে মতিউর-লায়লার নামে যৌথভাবে থাকা ৪৮.১৬ শতাংশ এবং মতিউর-লায়লা-অর্নবের নামে যৌথভাবে থাকা আরও ৪৫.১৬ শতাংশ জমিও রয়েছে জব্দের আদেশ হওয়া স্থাবর সম্পত্তির তালিকায়।

গাজীপুরে শুটিং স্পট ও ভালুকায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান:

জব্দ আবেদনের নথি সূত্রে জানা যায়, মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরে রয়েছে একটি শুটিং স্পট। আপন ভুবন নামের এ শুটিং স্পটটি ৬৩৬.৩৬ শতাংশ বা ৬.৩৬ একর জমির ওপর অবস্থিত। এসব জমির মধ্যে ১৫২ শতাংশ জমি খোদ শুটিং স্পটের নামে দলিল করা। শুটিং স্পটের বাকি ৪৮৪.৩৬ শতাংশ জমি মতিউর পরিবারের সদস্যের নামে।

এছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী মৌজায় রয়েছে মেসার্স গ্লোবাল সুজ লিমিটেড নামক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এ কোম্পানির নামে রয়েছে ৬৬ শতাংশ জমি এবং কোম্পানির পক্ষে মতিউরের ভাই এমএ কাইউম হাওলাদারের নামে রয়েছে ৮৯২ শতাংশ বা ৮.৯২ একর জমি।
অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা অস্থাবর সম্পদ:

এছাড়াও অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে, ১১৬ টি পৃথক ব্যাংক একাউন্টে থাকা ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা এবং শেয়ারবাজারে থাকা ২৩ টি বিও একাউন্ট। এসব ব্যাংক একাউন্ট মতিউর, তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয় ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের নামে খোলা হয়েছিল।

২৩ টি ব্যাংকে তাদের নামে ছিল ১১৬ টি একাউন্ট। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংকে রয়েছে ৬টি একাউন্ট, এনআর‌বিসি ব্যাংকে ২টি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১২টি, জনতা ব্যাংকে ১টি, ব্রাক ব্যাংকে ৬টি, এসসিবি‌ ব্যাংকে ২টি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ১টি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২টি, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ৬টি, কমিউনিটি ব্যাংকে ১টি, ডাচ বাংলা ব্যাংক ২টি, সাউথইস্ট ব্যাংকে ১টি, মিডল্যান্ড ব্যাংকে ১টি, ইউসিবি ব্যাংকে ১টি, ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে ১৫টি, বিকাশ লিমিডিটে ৩টি, ওয়ান ব্যাংকে ৩৯টি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২টি, এসবিএসি ব্যাংকে ১টি, একজিম ব্যাংকে ১টি, অগ্রনী ব্যাংকে ৪টি, মধুমতি ব্যাংকে ২টি, ঢাকা ব্যাংকে ৪ টি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১ টি একাউন্ট।
এদিকে গত ২৪ জুন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাদের পুত্র আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবকে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। এরপর ৩০ জুন এ বিদেশযাত্রা প্রত্যাহার চেয়ে আদালতে আবেদন করেন লায়লা কানিজ। আগামী ২৮ জুলাই এ বিষয়ে আদালতে শুনানি হওয়ার জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

ছাগলকাণ্ডে আলোচিত ইফাতের কথিত বাবা জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের সদস্য মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চারবার অনুসন্ধান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবারই অনুসন্ধান পর্যায় থেকে শেষ হয়েছে কার্যক্রম। সম্প্রতি মতিউরের বিরুদ্ধে ফের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

এদিকে এরই মধ্যে মতিউর রহমান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি ইফাত নামের এক তরুণ কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সবাই খুঁজতে থাকেন এত টাকার উৎস কী? তখনই সামনে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তা মতিউর রহমানের নাম। যদিও এক পর্যায়ে নিজের ছেলেকেও অস্বীকার করেন মতিউর। আলোচিত সেই ঘটনার পর আর শেষ রক্ষা হয়নি মতিউরের। এনবিআরের পদ থেকে সরিয়ে তাকে সংযুক্ত করা হয় অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে।

জানা যায়, মতিউর রহমানের ছেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ৭০ লাখ টাকার গরু কেনেন বলেও উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরপর থেকে মতিউর রহমানের ছেলের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন, মতিউর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এই কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)