দেশের ১১.৪ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক, বাঁচার উপায়
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ডেস্ক:
দেশের শতকরা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এর মধ্যে পুরুষ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ও নারী ১১ দশমিক দুই শতাংশ। আর এলাকাভিত্তিক বিবেচনায় রংপুরে সর্বোচ্চ ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষ মারাত্মক এই রক্ত রোগের বাহক।
রোববার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে জাতীয় থ্যালাসেমিয়া সার্ভে ২০২৪ এ প্রকাশিত জরিপে এ তথ্য দেওয়া হয়।
থ্যালাসেমিয়ার কারণ
ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। ফলে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে মাত্র ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ব লোহিত রক্তকণিকার ভাঙনের দরুন রক্তস্বল্পতা দেখা যায়।
বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ, বাহক শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ আর সুস্থ শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ।
ভাই-বোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তান-সন্ততির থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, যারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক তাদের মধ্যে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শিশুকাল থেকেই থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-
১. রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে দেখাবে।
২. চেহারায় হলুদ ভাব থাকবে অর্থাৎ জন্ডিস থাকবে।
৩. চেহারার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে, মুখ চ্যাপ্টা, কপাল, থুতনি, সামনের দাঁত একটু প্রমিনেন্ট থাকে। যেটাকে থ্যালাসেমিয়া ফেসিস বলা হয়।
৪. শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, প্লীহা বড় হয়ে যায়।
৫. রক্তশূন্যতার জন্য ঘন ঘন রক্ত দেওয়ার কারণে শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায়। হার্টে, লিভারে ও বিভিন্ন এন্ড্রোক্রাইন অর্গানের মধ্যে অতিরিক্ত আয়রন জমতে থাকে। এর ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক বয়োবৃদ্ধ ও সেকেন্ডারি সেক্স ক্যারেকটার প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটবে। এক সময় ডায়াবেটিস, হার্ট ফেইলিউর ও লিভার সিরোসিসের মতো জটিল সমস্যাও হতে পারে।
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য এইচপিএলসি পরীক্ষার করা দরকার। পরীক্ষাটির পুরো নাম হল ‘হাই পাওয়ার লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি’।
নিতে হবে চিকিৎসা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাই তাদের চিকিৎসা হওয়া উচিত একজন শিশু রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে। রোগীকে রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি অবশ্যই ‘আয়রন চিলেশন’ চিকিৎসাও নিতে হবে। তা না হলে রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে আয়রনের বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে রোগী মারা যান।
‘আয়রন চিলেশন’ চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে বাংলাদেশের অধিকাংশ রোগীই তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না, তাঁরা শুধু মাসে মাসে রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা সম্পন্ন করেন। ফলে এই রোগীদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এসব রোগীর আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ব্যাপারে থাকে বিধিনিষেধ। আর আয়রনসমৃদ্ধ ওষুধ খাওয়া যাবে না একদমই।
প্রতিরোধের উপায়
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধকল্পে বিবাহপূর্ব রক্ত পরীক্ষার বিষয়টি উৎসাহিত ও বাহকদের মধ্যে বিবাহ নিরুৎসাহিত করতে হবে। সিবিসি ও হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিসের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করা যায়। গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি-না জানার জন্য ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং প্রভৃতি পরীক্ষা করা যায়। তবে এসব পরীক্ষা গর্ভাবস্থার ১৬-১৮ সপ্তাহে করানো উচিত।