তালায় খান বোরহানউদ্দিনের গণঘের এখন এলাকাবাসীর মরণ ফাঁদ
রঘুনাথ খাঁঃ নিয়মবহির্ভুতভাবে পানি নিষ্কাশনের প্রবাহমান খাল দখল করে বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়েছে। ওই খালে শ্যালো মেশিন বসিয়ে কৃষি জমিতে পানি তুলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে এলাকার কৃষি। লীজ দিতে না চাইলে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জোর করে দখলে নেওয়া হচ্ছে মালিকানাধীন কৃষি জমি। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খড়েরডাঙা গ্রামের খান মোহাম্মদ বোরহানউদ্দিনের এহেন কর্মকান্ডের ফলে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোন ফল না পাওয়ায় এলাকায় চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
শনিবার সকালে সরেজমিনে তালা উপজেলার খড়েরডাঙা গ্রামে যেয়ে জানা গেছে ঘোনা, মাঝিয়াড়া ও কিসমতঘোনাসহ কয়েকটি মৌজার বর্ষার পানি ৩০ ফুট চওড়া পাশখালি খাল দিয়ে গোপালপুর ¯øুইজগেটের মাধ্যমে কপোতাক্ষ নদে পড়তো। কপোতাক্ষ নদ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিলের পানি নীচে নামতে না পারায় ২০১১ সাল থেকে তীরবর্তী কেসমতঘোনা, খানপুর, মুড়াকুলি, দাউনিপাড়া, শাহপুর, খড়েরডাঙা, গোপালপুরসহ কমপক্ষে ২৭টি গ্রাম বছরে ছয় মাস পানিবন্দি হয়ে থাকতো। একপর্যায়ে ২০১২ সাল থেকে খড়েরডাঙা গ্রামের মৃত আলতাপ হোসেন খান এর ছেলে খান মোঃ বোরহানউদ্দিন মালিকদের কাছ থেকে কম টাকায় লীজ নিয়ে খড়েরডাঙা বিলে মাছ চাষ শুরু করেন। ৮৮-৮৯ অর্থবছরে ১০ জনের বন্দোবস্ত নেওয়া পাশখালি খালের দুই একর ২৪ শতক জমি কৌশলে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে লম্বালম্বিভাবে ৩০ ফুট চওড়া খালের ১৫ ফুট মাছের গণ ঘেরের মধ্যে নিয়ে নেন বোরহানউদ্দিন। পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় ওই এলাকার কাঁচা রাস্তা ভেঙে যেতে থাকে। বিপন্ন হয় উঁচু জমির ফসল। বেশ কিছু পরিবার হয়ে পড়ে পানিবন্দি। এমনকি এলাকায় উঁচু জমি না থাকায় সিরাজুলের মৃতদেহ ঘোনায়, কানাই সরদারের মৃতদেহ কেশবপুরে, ইয়ার মাহমুদের মৃতদেহ কেশবপুর উপজেলার ভগতি গ্রামে, নবুর মাকে গোনালী, শহর আলীকে তালার মাঠে কবরস্ত করা হয়। কয়েকজনকে বস্তাভরে মাটি উঁচু করে কবর দেওয়া হয়। প্রথম ছয় বছর ঘের করার পর বর্তমান সরকারের অর্থায়নে কপোতাক্ষ খনন করা হয়। জলাবদ্ধতা দূর হওয়ায় ফলে এলাকায় বছরে তিনটি ফসল উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু বোরহানউদ্দিন কয়েকজন প্রভাবশালীর সহায়তায় আবারো ৪০/৪২ জনের কাছ থেকে কৃষি জমি লীজ নিয়ে পাশখালি খালের অর্ধেকাংশে বেড়িবাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। চলতি বছরের ৩০ মার্চ তার লীজের মেয়াদ শেষ হয়। এ মাছ চাষে তিনি অনিবন্ধিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে মৎস্য বিভাগের লাইসেন্স গ্রহণ করলেও স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে তা বাতিল হয়।
সরেজমিনে যেয়ে আরো জানা গেছে, বোরহানউদ্দিনের দ্বিতীয়বারের লীজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে প্রভাবশালি কয়েকজনের কাছ থেকে শতাধিক বিঘা জমি তৃতীয় বারের জন্য লীজ নেন। খড়েরডাঙার ইদ্রিস মোড়ল, খানপুরের তরিকুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান সরদার ওরফে বাবু, ময়জুদ্দিন সরদার ও জলিল সরদার তাদের প্রায় ২০ বিঘা জমি লীজ দিতে রাজী হননি। পাট লাগানোর কথা বলায় ক্ষুব্ধ হন বোরহানউদ্দিন। তাদেরকে হুমকি ধামকি দেন বোরহানউদ্দিন ও তার ভাড়াটিয়া বাহিনীর সদস্যরা। বিষয়টি নিয়ে তারা গত ২৯ জানুয়ারি অভিযোগ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফিয়া শারমিন তালা সহকারি কমিশনার(ভ‚মি) , তালা থানার ওসি তদন্ত , তালা সদর ইউপি চেয়ারম্যান ও সদর ইউনিয়ন ভ‚মি কর্মকর্তাকে যৌথভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেন। একপর্যায়ে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে ইদ্রিস মোড়লসহ কয়েকজন পাশখালি খালের বেড়িবাঁধের চারটি স্থান কেটে দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে চারজন তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ায় বিষয়টি গণশুনানীতে নেওয়া হয়। মাছের ঘের করার জন্য বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বেগতিক বুঝে খান মোঃ বোরহানউদ্দিন পাশখালি খালের অংশ বিশেষসহ লীজ নেওয়া জমিতে মাছ চাষে ইদ্রিস মোড়লসহ পাঁচজন বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে গত ২৫ মার্চ পিটিশন ৬৩৯/২৪ নং মামলা দায়ের করেন। বিবাদীপক্ষ নোটিশ না পাওয়ার আগেই কৌশলে ২৭ মার্চ সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে বিবাদী ৫জনকে তাদের নিজ জমিতে প্রবেশের জন্য বারিত আদেশ করা হয়। পরবর্তীতে ৯ এপ্রিল ওই আদেশ বর্ধিত করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে ইদ্রিস মোড়লসহ পাঁচজন বিবাদী অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিেেষ্ট্রট এর বারিত আদেশের বিরুদ্ধে ১৮ এপ্রিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা(১৪৫/২৪) করেন। বিচারক চাঁদ মোহাম্মদ আব্দুল আলিম আল রাজী রিভিশন মঞ্জুর করে ২৭ মে পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের ২৭ মার্চ ও ৯ এপ্রিলের রায় স্থগিত করেন। একই দিনে ওই রিভিশন নিষ্পত্তির জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। গত ৯ জুন রিভিশন শুনানী শেষে বিচারক রাখিবুল ইসলাম অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের রায় এর উপর স্থগিতাদেশ বহাল রেখে উভয়পক্ষের সাক্ষীসহ শুনানী অন্তে মামলা নিষ্পত্তির জন্য পাঠিয়ে দেন।
খড়েরডাঙা গ্রামের ইদ্রিস মোড়ল, শাহীনা খাতুন, সমছের আলীসহ কয়েকজন পাশখালি খালের বটতলায় শ্যালো মেশিন দিয়ে নোনা পানি ঘেরে তুলে মাছ চাষকরা হচ্ছে দেখিয়ে বলেন, আদালতের রায় মানেন না ইদ্রিস মোড়ল। এ সময় পাঁচটি শ্যালো মেশিন ও দুটি পাম্প বসিয়ে লোনা ও মিঠা পানি তোলা হচ্ছিল ঘেরে।
খানপুরের তরিকুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান ও জলিল সরদার জানান, গত ১১ জুন তাদের কেটে দেওয়া পাশখালি খালের বেড়িবাঁধ দুই শতাধিক সশস্ত্র লোকজন নিয়ে আবারো বেঁধে দিয়েছে বোরহানউদ্দিন। ১২ জুন বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিং এ উপস্থাপন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান দ্রæত পানি তোলা বন্ধ করার ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেন। এরপরও বেপরোয়া বোরহানউদ্দিন।
এ ব্যাপারে খান মোঃ বোরহানউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার ছেলে জুবায়ের আহম্মেদ এ প্রতিবেদককে জানান, তারা আইন মেনেই জমির মালিকদের কাছ থেকে লীজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন। একটি মহল তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফিয়া শারমিন ও উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার বলেন, যারা জমিতে ফসল উৎপাদন করতে চার তাদের জমিতে জোর করে ঘের করা যাবে না। প্রবাহমান খালে বাঁধ দিয়ে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। বোরহানউদ্দিনের পাশখালি গণঘেরে অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রæত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।