কাটা হচ্ছে বনের গাছ ও পাহাড়
ডেস্ক রিপোর্ট: চারদিকে ঘন জঙ্গল। মাঝে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দুর্গম বারবাকিয়া এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পর্যন্ত নেই। রাত গভীর হলেই সারি সারি ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায় বনের গাছ। এভাবে চলতে থাকায় প্রায় ৮ হাজার একর বনভূমি উজাড় হওয়ার পথে। পাহাড় কেটে মাটি ও বালু বিক্রি করা হচ্ছে। বছরের পর বছর এভাবে চললেও দেখার কেউ নেই। কারণ, খোদ বন বিভাগের কর্মকর্তারাই যে এই অপকর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা রাখছেন স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এবং কিছু নামধারী ‘সাংবাদিক গহিন এই অরণ্যে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বাস করে কিছু পরিবার। তবে বন কর্মকর্তাদের গড়ে তোলা এই সাম্রাজ্যে বলতে গেলে তাদের কোনো অধিকারই নেই। গাছ ও পাহাড় কাটাসহ নানা অনিয়ম চললেও তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার জো নেই এই মানুষগুলোর। উল্টো অনেকেই বিনা মজুরিতে এসব কাজ করে দিতে বাধ্য হন। কারণ, হুকুমমতো না চললেই নেমে আসে মামলার খড়্গ।সরেজমিন দেখা গেছে, কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা সদর থেকে দুর্গম মেঠোপথ পেরিয়ে বারবাকিয়া এলাকায় পৌঁছতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে একটা নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে যাওয়া গেলেও বাকিটা হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। প্রায় ১৫ হাজার একরের সুবিশাল এ বনভূমিতে রয়েছে বন বিভাগের তিনটি বিট—টইটং, বারবাকিয়া ও পহরচাঁদা। পুরো এলাকার দায়িত্বে আছেন একজন রেঞ্জ প্রধান। এই কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বনের দেখভাল হলেও তারাই বনখেকো হয়ে উঠেছেন।বংশপরম্পরায় ওই এলাকায় বাস করেন আলাউদ্দীন শেখ। গরু-ছাগল পালন এবং কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই অঞ্চলের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষের নামে বন কর্মকর্তাদের দেওয়া মামলা রয়েছে। এর আগে আমার বিরুদ্ধেও একটা মামলা হয়েছে। কেউ মুখ ফুটে কথা বলবে না। এখানে আমরা দাসের মতো জীবনযাপন করি। বন কর্মকর্তা যা বলবেন, তাদের মুখের কথাই আইন।একই ভাষ্য পাশে দাঁড়ানো ২০ বছরের তরুণ সাইফুলেরও। তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এটিও যদি বন কর্মকর্তারা জানতে পারেন, তবে নিশ্চিত একাধিক মামলা হবে। যারা কথা শোনে না তাদের বিরুদ্ধে গাছ চুরি, পাহাড় কাটার মামলা দেওয়া হয়। অথচ তারা নিজেরাই বনের গাছ কেটে সাবাড় করতেছে। কেউ দেখে না।’দুজনের কথার সত্যতা যাচাই করতে এই প্রতিবেদক যান পাশেই পাহাড়ের ওপরে থাকা একটি খুপরি ঘরে। সেখানে দেখা মেলে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী নারী হাওয়া বেগমের সঙ্গে। তিনিও কথা বলতে চাননি। তবে গবেষণার কাজে পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের জীবনাচারণ জানতে চেষ্টা করছি, এমনটা জানানোর পর কথার ঝাঁপি খুলে বসেন। হাওয়া বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন এখানে শত শত গাছ কাটা হয়। স্থানীয় মানুষজনকে দিয়ে সেই গাছ কাটানো হলেও কোনো মজুরি দেওয়া হয় না। কেউ টাকা চাইলে দেওয়া হয় মামলা।তিনি বলেন, ‘এই যে খুপরিটা তুলেছি। এ জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে বন কর্মকর্তাকে। এরপর আবার এখানে প্রতি মাসেই কয়েকজন সাংবাদিক আসেন। তাদেরও দুইশ-পাঁচশ করে টাকা দিতে হয়।’পাহাড় থেকে নেমে আসার পর দেখা মেলে ৬৫ বছরের এন্তাজ আলীর। তারও কথা, ‘আমরা সরকারের কাছে কিছু চাই না। বন কর্মকর্তারা যেন অত্যাচার না করেন।তিনি বলেন, ‘এসব বন দেখভাল করা এবং যত্ন নেওয়ার জন্য সরকারের বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বন কর্মকর্তারা এই এলাকার মানুষকে মজুরি ছাড়াই ব্যবহার করেন। প্রতি মাসে গড়ে এক দিন বা দুদিন আমাদের বন কর্মকর্তাদের হুকুমে কাজ করতে হয়। অথচ আমরা দিন আনি দিন খাই। এক দিন কাজ করতে না পারলে ভাত জোটে না। আমরা দাবি জানিয়েছিলাম, সামান্য হলেও যেন মজুরি দেওয়া হয়। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের বিরুদ্ধে দিয়েছে মামলা।ওই এলাকা ঘুরে অন্তত ত্রিশজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে কালবেলা। প্রত্যেকেই জানান, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে বন বিভাগ। রান্নার জন্য একটা বাঁশের কঞ্চি ধরলেও মামলা দিয়ে দেয়। অথচ বন কর্মকর্তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে দিনরাত বন এবং পাহাড় কাটা হয়।ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাহাড়ি এলাকায় একটা খুপরি ঘর তুলতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। টিনের ঘর তুললে দিতে হয় এককালীন ৫০ হাজার টাকা। এরপর প্রতি মাসেই আলাদা করে টাকা দিতে হয়।তারা বলেন, সাংবাদিক পরিচয়ধারী কয়েকজন প্রতি মাসে টাকা নেন। এ ক্ষেত্রে ঘর বাবদ টাকা নেওয়ার পাশাপাশি তারা গাছ কাটা বাবদও টাকা নেন।বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তাঘাট নেই। মাঝেমধ্যে পাহাড়ের ঢাল কিংবা উপরে দেখা মেলে খুপরি ঘর। বেশিরভাগ পাহাড়ই কাটা। খুবলে নেওয়া হয়েছে বালু-মাটি। এসব এলাকার বনের বিপুলসংখ্যক গাছ কাটা হয়েছে। একরের পর একর জমির গাছ উধাও। এমনকি সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে মূল্যবান ‘মাদার’ বৃক্ষ গর্জনও দেদার কাটা হচ্ছে। বন কর্মকর্তারা সরাসরি গাছ পাচারে যুক্ত থাকায় এসব হয় অনেকটা প্রকাশ্যেই।স্থানীয়দের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাত ১টার দিকে টইটং এলাকায় অপেক্ষা করেন এই প্রতিবেদক। দেখা যায়, সারি সারি ট্রাক, মিনি ট্রাকবোঝাই গাছ পাচার হচ্ছে। আশপাশেই ঘুরঘুর করছেন বন কর্মকর্তাদের দালালরা। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা হয়। বলেন, পাহাড়ি এলাকার অঘোষিত সম্রাট বন বিভাগের বরবকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক। তার নির্দেশেই এসব ট্রাক থেকে টাকা তোলা হয়। জিপপ্রতি ১ হাজার, মিনি ট্রাক ৩ হাজার, বড় ট্রাক ৫ হাজার এবং টিসি ট্রাক ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয় হাবিবুল হককে।বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বনের গাছ কাটা এবং জায়গা দখল করছেন স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীও। এর মধ্যে রয়েছে টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। বন বিভাগের সংরক্ষিত প্রায় ১০ একর বনভূমি দখল করে বাগান গড়ে তুলেছেন তিনি। নির্মাণ করেছেন বৈঠকখানা। বিশ্রাম ও বিচার-সালিশ করছেন সেই বৈঠকখানায়। স্থানীয়রা বলছেন, জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে দহরম সম্পর্ক বন কর্মকর্তা হাবিবুল হকের। মাঝেমধ্যে অবকাশ যাপনেও আসেন। আর এর বদৌলতেই খুইন্যাভিটা এলাকায় প্রায় ১০ একর সংরক্ষিত বনভূমির ঘন জঙ্গল ও গাছপালা কেটে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানের লোকজন। এরপর বিশ্রামের জন্য তৈরি করা হয়েছে বাঁশ ও কংক্রিটের ঘর।শুধু বনের গাছই নয়, প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বালু এবং মাটিও বিক্রি হয় পাহাড় থেকে। বরবকিয়া এলাকার দুর্গম এক পাহাড়ের ঢালে দেখা মেলে বেশ কয়েকটি উঁচু বালুর ঢিবি। যেগুলো পাহাড় কেটে জমা করা হয়েছে। ওই বালু কেটেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী জাকির হোসেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এসব বালু রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হকের অনুমতি নিয়েই জমা করা হয়েছিল। তিনি এ বালু উত্তোলন বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়েছেন। এরপর এখন আবার ২০ লাখ টাকা দাবি করেছেন। সেই টাকা দিতে না পারায় বালু বিক্রি করতে পারিনি।তিনি বলেন, ‘হাবিবুলের অনুমতি নিয়েই পাহাড় কাটা হয়েছে। নিজের জমানো সব সম্বল শেষ করে বালু কেটেছিলাম। এখন আমি নিঃস্ব। হাবিবুলকে ফের টাকা দিতে না পারায় বালু বিক্রি করতে পারিনি।শুধু এই জাকির হোসেনই নন, তার মতো অনেকেই এমন রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুলকে টাকা দিয়ে বালু এবং গাছ কাটেন। এমন অন্তত চারজনের সঙ্গে কথা হয়েছে কালবেলার। তারা প্রত্যেকেই টাকা দিয়ে গাছ এবং পাহাড় কাটার কথা স্বীকার করেছেন।যোগাযোগ করা হলে রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ মিথ্যা। এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্প্রতি বালুমহাল নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। এর পর থেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘বালু এবং পাহাড় কাটার অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কোনো ঘরবাড়ি বানানোর সুযোগ নেই।তিনি বলেন, ‘গাছ কাটার বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান কালবেলাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ আসেনি। কেউ অভিযোগ দিলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।