সাতক্ষীরার কুলতিয়া খালে সুইচগেট নির্মাণে অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ

রঘুনাথ খাঁ ঃ সাতক্ষীরার বিনেরপোতা কুলুতিয়া খালে পানি নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রক বা সুইচগেট নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দুদকের তদন্তে এ পাহাড় প্রমাণ দূর্ণীতির বিষয়টি উঠে আসে। দুদকের পক্ষ থেকে করা হয়েছে মামলা।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, কাজ মোটামুটি সঠিকভাবে করলেও ঠিকাদাররা রেওয়াজ অনুযায়ি যেভাবে খুশি করার চেষ্টা করেন, তাতে সবারই খুশি থাকার কথা। কিন্তু এখানে যা ঘটেছে, তা পুরোপুরি মাটির নিচে সরকারি অর্থ লুটপাটের খোলামেলা আয়োজন।
এদিকে কুলতিয়া খালে ¯øুইচগেট নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম দ্রুত মাঠে নামে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে আউটসোর্সিং করে গত ১৪ মে হাজির হয় ঘটনাস্থল সাতক্ষীরার বিনেরপোতা কুলুতিয়া খালে। সেখানে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে লুটপাটের সব প্রমাণ। এ ধরনের গেট নির্মাণে স্থায়িত্ব ঠিক রাখতে মাটির ২০ ফিট গভীর থেকে শিট পাইলিং করার কথা থাকলেও করা হয়েছে মাত্র ১০ ফিট। এরপর ঘটনাস্থল থেকে ফিরে দুদক এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালককে চিঠি দেয়। এছাড়া দুদক তার আইনবলে গত ১৫ মে পৃথক মামলাও করে।এদিকে এ ঘটনায় নিম্নপদের দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। অথচ এই দুই কর্মকর্তাই ঠিকাদারের বিল পরিশোধের সব ব্যবস্থা করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাউবো মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা সাংবাদিকদের বলেন, ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) ও উপসহকারী প্রকৌশলীকে (এসও) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে দ্রæত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কাজের বিল পরিশোধের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর কী ভূমিকা ছিল তা তদন্ত প্রুিতবেদনে উঠে আসবে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি একেবারেই দুঃখজনক। এ ঘটনায় পাউবোর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। সরেজমিনে কুলতিয়া খালে যেয়ে দেখা গেছে, পাইলের দৈর্ঘ্য ৬ মিটারের স্থলে তিন মিটার (১ মিটার=৩.২৮১ ফিট) দেওয়া হয়। এখানে কাজ বাস্তবায়নের যে শর্ত (স্পেনিফিকেশন) দেওয়া হয় তার অর্ধেক চুরির প্রমাণ পায় দুদক কর্মকর্তারা।এছাড়া ঠিকাদারের প্রতিনিধি ও শ্রমিকরা সবগুলো শিট পাইলের দৈর্ঘ্য ৬ মিটারের স্থলে ৩ মিটারের কথা স্বীকার করে। অর্থাৎ ১৪০টি শিট পাইলের সবকটিতেই ৬ মিটারের স্থলে তিন মিটার দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাকে চরম অনিয়ম ও দূর্ণীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। চলমান এই কাজের দুর্নীতির বিষয়ে পাউবোর খুলনার প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড -১ এর তৎকালিন নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে শোকজ করেন। এ বিষয়ে বলা হয়, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ন্ত্রক এর নকশায় ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের শিট পাইল সংস্থান ছিল। সেখানে ৩ মিটার শিট পাইল স্থাপনের অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রাপ্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিট পাইলের ক্যাপ ভেঙে উত্তোলন করে সরেজমিন দেখাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বর্ণিত নিয়ন্ত্রক পাইল ক্যাপ ভেঙে প্রধান প্রকৌশলীকে না জানিয়ে ৩০টি শিট পাইল উঠিয়ে সাইট থেকে অন্যত্র সরানো হয়েছে; যা প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে তিনি জানেন না। পরে ১৩ মে প্রকল্পের পিডি সবিবুর রহমানকে নিয়ে সাইট পরিদর্শনে যান প্রধান প্রকৌশলী।ওই সময়ও অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পান খুলনা পাউবোর এই শীর্ষ কর্মকর্তা। এর পরদিনই দুদকের সমন্বিত খুলনা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন। এ ঘটনার পর পাউবোর প্রধান কার্যালয় থেকে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) জাকারিয়া ফেরদৌস ও উপসহকারী প্রকৌশলী অনি দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে বদলী করা হলেও প্রকল্প পরিচালক রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা-১ এর বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলামের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।পাউবোর একজন কর্মকর্তা জানান, নিম্নপদের দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বোর্ড যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে তাও রহস্যজনক। এই তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়েই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, যা সম্পূর্ণ রহস্যজনক।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুধু পানি নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রক নির্মাণের এই একটি প্যাকেজে নয়, লুটপাটের মহা আয়োজন করা হয়েছে ৭৪টি প্যাকেজে। ৪৭৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পের পিডি করা হয়েছে পাউবো খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৗশলী সবিবুর রহমানকে। কক্সবাজার ও সুনামগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাবস্থায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কাজের বাস্তব ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত খরচ করার গুরুতর অভিযোগ ছিল। একজন প্রভাবশালীর তদবিরে তিনি বারবার বেঁচে গেছেন।
একই সূত্রে বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে চলমান এ প্রকল্পের পিডিও করা হয়। অভিযোগ আছে, মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালীর কাছের মানুষ হওয়ায় তিনি কোনো চেইন অব কমান্ড মানেন না। এ নিয়ে পাউবোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা নাখোশ। পাউবোর টাস্কফোর্সের সাবেক আহ্বায়ক কাজী তোফায়েল হোসেন দায়িত্বে থাকাকালীন কোটি কোটি টাকার বাস্তব ব্যয় এর চেয়ে অতিরিক্ত খরচের তথ্য পায়।তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দুদক কুলুতিয়া খালে নিয়ন্ত্রক নির্মাণের যে প্যাকেজে অভিযান চালায় সেখানে ব্যয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। কাজটি করছে খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিন অ্যান্ড কোং। এ কাজে বিল পরিশোধের সুপারিশের জন্য দুদকের প্রতিবেদনে দায়ী করা হয় নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে। এ ছাড়া খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পিডি মো. সবিবুর রহমানও দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তিনি চূড়ান্তভাবে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করেন।দুদক এর খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় শিট পাইল ব্যবহারে নানা অনিয়মের অভিযোগ পায় দুদক। অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট শাখা গত ১৪ মে অভিযান পরিচালনা করে।
এ সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা ও সরেজমিন পর্যবেক্ষণে ওই প্রকল্পে ১৪০টি শিট পাইল স্থাপন করার তথ্য পাওয়া যায়। পরে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে দুটি শিট পাইল উত্তোলন করা হয়। এ সময় বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাতক্ষীরার দুজন নিরপেক্ষ প্রকৌশলী দিয়ে পরিমাপের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার পাউবোর মাধ্যমে ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৮টি প্রকল্প হাতে নেয়।এর মধ্যে ৭৪টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হলেও কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ৭৩টি প্যাকেজ বাস্তবায়নে। ব্যয়বহুল এই কাজের মধ্যে নতুন নিয়ন্ত্রক নির্মাণ রয়েছে ৬টি। আরও ৪টি প্যাকেজে ২১টি নিয়ন্ত্রক মেরামতের কাজও আছে। এছাড়া মারিচ্চাপ নদী ও বেতনা নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজে।
এর মধ্যে মরিচ্চাপ নদীতে ৩৭ কিলোমিটার খননের কাজ রাখা হয়েছে এক্সকেভেটর যন্ত্রের মাধ্যমে। আর বেতনা নদী ড্রেজার যন্ত্রের মাধ্যমে ড্রেজিং এর কাজ আছে ৪৪ কিলোমিটার। এছাড়া বেতনার সাড়ে ২৩ কিলোমিটার কাটা হবে এক্সকেভেটর দিয়ে। বাঁধ মেরামত ১১৩ কিলোমিটার এবং বাঁধ মেরামত ও পৌনে দুই কিলোমিটার বাঁধের প্রতিরক্ষা কাজও আছে ৪টি প্যাকেজে।
সরেজমিনে যেয়ে দেখা গেছে, চলমান এসব প্যাকেজের কাজে যে অগ্রগতি দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায়নি। যেমন দুদক যে প্যাকেজে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে সেখানে গত ২১ মে পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ২৫ ভাগ। দুদকের অভিযানের পর সেখানে সম্পূর্ণ কাজ বন্ধ রয়েছে। একই প্যাকেজে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৫ ভাগ কাজই যেখানে বন্ধ সেখানে কাজের শতকরা হার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)