ভুয়া চাকরি দেখিয়ে ভিসা বিক্রি: সিন্ডিকেটের পকেটে ১৩ হাজার কোটি টাকা

ডেস্ক নিউজ:
রিক্রুটিং এজেন্সি ম্যাক্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেড (নিবন্ধন নম্বর ১০৮৪) গত ১৮ আগস্ট মালয়েশিয়ার পাওয়ার প্লাগ বাসডাক্ট কোম্পানিতে ৯৭ কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র পায়। মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশি মধ্যস্বত্বভোগী মনিরুজ্জামান তা পাঠান। মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার (এফডব্লিউসিএমএস) স্বীকৃত ছিল চাহিদাপত্রটি।
চাহিদাপত্র পেয়ে ‘ভিসার দাম’ বাবদ ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেয় ম্যাক্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেড। পরে পাওয়ার প্লাগ বাসডাক্ট কোম্পানিতে যোগাযোগ করে জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি চাহিদাপত্র দেয়নি। ভুয়া চাহিদাপত্র দিয়ে ‘ভিসা বিক্রির’ অভিযোগে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় আলাদা মামলা হয়।

এই একটি ঘটনা নয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এমন অসংখ্য অনিয়ম হয়েছে। সরকার অভিবাসন খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করলেও কর্মীপ্রতি সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও ভিসা (আসলে চাহিদাপত্র) কেনাবেচা হয়েছে দেদার। প্রতিটি ভিসা কেনা হয়েছে ন্যূনতম ৬ হাজার রিঙ্গিত বা দেড় লাখ টাকায়। নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের হোতাদের কর্মীপ্রতি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে।

এ হিসাবে অন্তত সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে দুই দেশের সিন্ডিকেট। আরো হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ও ঘুষ লেনদেন হয়েছে। তা পেয়েছেন স্থানীয় দালাল এবং সরকারি কর্মকর্তারা। ভিসা বিক্রি করতে ভুয়া চাকরি দেখিয়ে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে যাওয়া কর্মীরা চাকরি পাননি। বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন লাখো কর্মী। এ পরিস্থিতির মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।

রেমিট্যান্স তথ্য থেকেও ভিসা কেনাবেচার চিত্র স্পষ্ট। তাই ২১ মাসে ৪ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি কর্মী মালয়েশিয়া গেলেও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স বাড়েনি। বরং যে মাসে বেশি সংখ্যক কর্মী গেছেন, এর আগের মাসগুলোতে রেমিট্যান্স কমেছে। যেমন গত মার্চে আগের দুই মাসের প্রায় তিন গুণ ১৭ হাজার ৮৭৭ জন কর্মী মালয়েশিয়া যান। ফেব্রুয়ারিতে আগের মাসের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম ১২ কোটি ৭১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে মালয়েশিয়া থেকে।

জনশক্তি সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় থাকা কর্মীর আয় করা রিঙ্গিতে কেনা হয় ভিসা। তাই আসেনি রেমিট্যান্স। দেশে নতুন কর্মীর নেয়া টাকা থেকে রিঙ্গিত দেওয়া কর্মীর পরিবারের কাছে অর্থ পৌঁছে যায়। তাই দেশে আসে না রেমিট্যান্সের ডলার।

ম্যাক্স ম্যানেজমেন্টের মামলার এজাহার অনুযায়ী, ঢাকার বনানীতে হয় ভিসা কেনার টাকা লেনদেন। মালয়েশিয়ায় থাকা মনিরুজ্জামান সেখান থেকে ফোনে জানান, টাকা বুঝে পেয়েছেন। অর্থাৎ, হুন্ডি হয়েছে।

কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটকে চাঁদা এবং ভিসা কেনাবেচার বিষয়টি সবার জানা, তবে প্রমাণ নেই অজুহাতে ব্যবস্থা নেয়নি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম বলেন, সিন্ডিকেট এমন একটা বিষয়, তা মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে এর সমাধানের জন্য দুই দেশের সরকার পরস্পরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের দিক থেকে অভিযোগ না থাকলেও কর্মী নিপীড়নের সমালোচনায় মুখর জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ৪ মে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, সিন্ডিকেট কাগুজে কাজ দেখিয়ে বাংলাদেশি কর্মী নিচ্ছে।

রিক্রুটিং এজেন্সি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক এবং বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন বলেন, এ বিবৃতি ভিত্তিহীন।

অন্য এক জনশক্তি ব্যবসায়ীর ভাষ্য, রুহুল আমিন স্বপন মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক। যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

যেভাবে সিন্ডিকেট
নানা অনিয়মে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে মালয়েশিয়া। ২০১৫ সালে দেশটিতে ১০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর কাজ পায়। এ এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। সরকার ৩৭ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করলেও এজেন্সিগুলো কর্মীদের কাছ থেকে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ নিয়েছিল। এতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে অভিযোগে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় ফিরে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে মাহাথির মুহাম্মদ সরকার।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পরের বছরের ৮ আগস্ট আবার খোলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এর আগের মাসে ২৫ বাংলাদেশি এজেন্সিকে বাছাই করে ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের মালয় সরকার। কোন মানদণ্ডে ১ হাজার ৫২০ এজেন্সি থেকে ২৫টিকে বাছাই করা হয়েছে, তা কখনো জানায়নি দেশটি।

তবে ২০২২ সালের ৪ জুন অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল কোন ২৫ এজেন্সি কাজ পেতে যাচ্ছে। এ এজেন্সিগুলোও সিন্ডিকেট নামে পরিচিত। এতে সে সময়কার তিন এমপি এবং এক মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। বঞ্চিতদের সিন্ডিকেটবিরোধী আন্দোলনের পর আরো ৭৫টি বেসরকারি এবং একটি সরকারি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয় মালয়েশিয়া।

সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রক্রিয়ায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন, তাদের একজন বলেন, দুর্নীতির অভিপ্রায় ছিল গোড়া থেকেই। সে সময়ে আসা মালয় মন্ত্রী রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষমতা মালয়েশিয়ার হাতে রাখার শর্তে অনড় ছিলেন। তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এ শর্তে রাজি ছিলেন না। মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশেরও কয়েকজন প্রভাবশালীর চাপে সমঝোতা স্মারকে সই করতে হয়।

বাংলাদেশসহ ১৪ দেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। অন্য দেশের ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করে না। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এজেন্সি বাছাইয়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনশক্তি ব্যবসায়ীরা।

হাতানো হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকরা কর্মীপ্রতি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা নিয়েছে। ১০ হাজার টাকা সরকারি ফি এবং নিবন্ধনে লেগেছে। ১ লাখ ৭ হাজার টাকা সিন্ডিকেটের চাঁদা। বাকি ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছে সিন্ডিকেটে থাকা এজেন্সি।

জনশক্তি ব্যবসায়ীরা জানান, ভিসাপ্রতি আরো ৬ হাজার রিঙ্গিত (দেড় লাখ টাকা) দিতে হয়েছে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী, চাহিদাপত্র এনে দেওয়া দালাল এবং মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করা সিন্ডিকেটকে।

গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ লাখ ২২ হাজার কর্মীর চাহিদাপত্র দিয়েছে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীরা। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে গত ২৮ মে পর্যন্ত ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫০৯ কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। পরের তিন দিনে এ সংখ্যা ৪ লাখ ৬৫ হাজার ছাড়ায়। চাঁদা বাবদ ৬ হাজার ৬০৩ কোটি এবং এবং ভিসা কেনা বাবদ ৬ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। মোট ১৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা নিয়েছে দুই দেশের সিন্ডিকেট।

নিয়োগ প্রক্রিয়াই টাকা বানানোর মেশিন
জনশক্তি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মালয় নিয়োগকারীর কর্মী নিয়োগের আবেদন দেশটির সরকারের অনুমোদিত হয়ে এফডব্লিউসিএমএসের মাধ্যমে বাংলাদেশের এজেন্সির কাছে আসে। এফডব্লিউসিএমএস ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বেস্টিনেট নামের প্রতিষ্ঠান।

এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী দাতো আমিনুল ইসলাম বিন আবদুর নূর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক। তিনিসহ প্রতিষ্ঠানটির ৮ কর্মকর্তা ২০২২ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের অনিয়মের অভিযোগে। মালয়েশিয়ার বতর্মান উপপ্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি যখনই ক্ষমতায় ছিলেন, তখনই বেস্টিনেটের মতো তার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। যদিও তিনি বরাবরই বেস্টিনেটের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাহিদ হামিদি উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ফেরার পর দাতো আমিনুল ইসলাম আদালতের মাধ্যমে মুক্তিও পেয়েছেন।

১০ জনশক্তি ব্যবসায়ী জানান, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিবন্ধনের মাইগ্রামের ব্যবস্থাপনাতেও ছিল বেস্টিনেট। এটিই ছিল টাকা আদায়ের ফাঁদ। এতে কর্মীপ্রতি ১০০ রিঙ্গিত দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে এর নিয়ন্ত্রণ করেন ‘ক’ আদ্যক্ষরের বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকসহ কয়েকজন।

মাইগ্রামের ১০০ রিঙ্গিত নেয়া হয় রিক্রুটিং এজেন্সির ‘টপ আপ ই-ওয়ালেট’ থেকে। কর্মীপ্রতি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা চাঁদা না দিলে ই-ওয়ালেটে ব্যালেন্স দেওয়া হতো না। সিন্ডিকেটে থাকা এজেন্সিগুলো প্রথম ২৫ এজেন্সির পাঁচটি বাদে সবগুলো ৫ কোটি টাকা করে দিয়েছিল। প্রত্যেক কর্মী পাঠানোর সময় ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা করা সমন্বয় করা হয়েছে। পরে সিন্ডিকেটে ঢোকা ৭৫ এজেন্সিকেও আগাম টাকা দিতে হয়েছে।

মাইগ্রামের মাধ্যমে জিম্মি করার বিষয়টি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে জানিয়েও ফল হয়নি। গত বছরের ২ জানুয়ারির কুয়ালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠানো চিঠি এবং নথি অনুযায়ী, মাইগ্রামের বিষয়টি মালয় সরকারকে জানাতে বলা হয়েছিল।

মাইগ্রামের নিয়ন্ত্রক বেস্টিনেটের ঢাকা অফিস ক্যাথারসিস টাওয়ারে। এর মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াকে জিম্মি করার অভিযোগের বিষয়ে ক্যাথারসিস মালিক রুহুল আমিন স্বপনের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। তবে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে দীর্ঘ একটি ব্যাখ্যা পাঠিয়েছেন। যাতে বলা হয়েছে, কর্মী নিয়োগ হয়েছে নিয়ম মেনে।

লটারির খেলা, এমপিদের পকেটে টাকা
মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীরা বাংলাদেশ বাদে অন্য দেশ থেকে কর্মী নিয়োগে এফডব্লিউসিএমএস থেকে এজেন্সি পছন্দ বাছাই করতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অটো অ্যালোকেশন হয়েছে। অর্থাৎ এফডব্লিউসিএমএস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক করেছে, বাংলাদেশের কোন এজেন্সি কর্মী পাঠাবে। এ পদ্ধতি বন্ধে গত বছরের ২ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় চিঠি দিয়েছিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। জনশক্তি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার ক্ষমতাধররা জড়িত থাকায় কাজ হয়নি।

প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা নথি অনুযায়ী, অটো অ্যালোকেশনে গ্যালাক্সি কর্পোরেশনের (নিবন্ধন নম্বর ৭৯৫) নামে ৯৭ কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র আসে। এজেন্সিটির অথরাইজড এজেন্ট হিসেবে কর্মী পাঠানোর কাজ পায় ম্যাক্স ম্যানেজমেন্ট।

এ সুযোগ নিয়েছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকদের প্রতিষ্ঠানগুলো। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২৫ এজেন্সির কয়েকটি বাদে সবগুলো প্রায় সমান কর্মী পাঠিয়েছে। এ সংখ্যা সোয়া ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজারের মধ্যে।

জনশক্তি ব্যবসায়ীরা জানান, কয়েক এমপির প্রতিষ্ঠান আদতে কর্মী পাঠায়নি। অটো অ্যালোকেশনে পাওয়া চাহিদাপত্র অন্য এজেন্সির কাছে বিক্রি করে কর্মীপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজির আহমদের আহমদ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৪৬) গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৭ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী পাঠিয়েছে। যদিও মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটে ঢোকার আগে প্রতিষ্ঠানটি ৭ বছরে মাত্র ৩৮৭ কর্মী বিদেশ পাঠিয়েছিল।

ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রতিষ্ঠান স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড (আরএল-১৫৫১) ৭ হাজার ৮৪৯ জন কর্মী পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায়। সিন্ডিকেটে ঢোকার আগে এ এজেন্সির মাত্র ৯১ কর্মী বিদেশে পাঠানোর অভিজ্ঞতা ছিল।

ঘাটে ঘাটে আরো টাকা
সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বিমান ভাড়াসহ ১৫ রকম খরচ মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীর। সরকার রিক্রুটিং এজেন্সির ৫০ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ ধরে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছিল।

তবে সরকারি এজেন্সি বোয়েসেলের পাঠানো কর্মী ছাড়া কেউ সাড়ে ৪ লাখ টাকার কমে যেতে পারেননি। মালেয়শিয়া যাওয়া টঙ্গীর ফয়সাল আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। শুরুতে দালালকে দেন ৬ লাখ টাকা। বিমান ভাড়া বাড়ার কারণে গত মঙ্গলবার আরো ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ সচিব মো. রুহুল আমিন বলেন, বেশি টাকা নেয়ার অভিযোগ পায়নি মন্ত্রণালয়।

গেল এক মাস মালয়েশিয়ায় রয়েছেন এমন শতাধিক কর্মীর তথ্য অনুযায়ী, বিমান ভাড়া নিয়োগকারীর দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মীকে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় বিমানের টিকিট কিনতে হয়েছে। শেষ সময়ে এসে বিমান ভাড়া লেগেছে এক লাখ থেকে সোয়া এক লাখ টাকা।

প্রবাসী কল্যাণ সচিব বলেন, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার পর নিয়োগকারী বিমান ভাড়ার টাকা দিয়ে দেবে।

তবে আগে যাওয়া শতাধিক কর্মীর প্রত্যেকে জানিয়েছেন, কেউ ঢাকা ফেরত পাননি। স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ৪ লাখ ৬৫ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেলেও প্রায় ১৫ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে এফডব্লিউসিএমসের তালিকায় মেডিকেল সেন্টার। জনপ্রতি নেয়া হয়েছে ৭ হাজার ৩০০ টাকা।

ভিসা বিক্রি করতে ভুয়া চাকরি, কাজ পায়নি কর্মী
মালয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সুরিনা গ্লোবালে চাকরির শর্তে গত জুলাইয়ে মালয়েশিয়ায় যান সিরাজগঞ্জের জাহিদুল ইসলাম। তাকে দেশটিতে পাঠিয়েছিল রিক্রুটিং এজেন্সি স্টানফোর্ড এমপ্লয়মেন্ট লিমিটেড (নিবন্ধন নম্বর-১৩৫২)। তিনি জানান, চুক্তি অনুযায়ী সুরিনা গ্লোবালে চাকরি পাননি। নিজে অন্যত্র কাজ খুঁজে নিলেও নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না।

মেহেরপুরের গাংনীর সাহেব নগর এবং কাজীপাড়া গ্রামের ১৪০ জনকে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি মুসা ইন্টারন্যাশনাল (নিবন্ধন নম্বর-৮৫৭)। ৮ তরুণের অভিভাবকের পক্ষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গাংনী থানায় মামলা করেন তৈমরুজ্জামান নয়নের বাবা মোফাজ্জেল হোসেন।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, মুসা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুসা কলিম এবং স্থানীয় পাঁচ আদম ব্যাপারী প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়ায় নিয়ে কাজ না দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আটকে রেখেছে।

সিন্ডিকেটবিরোধী জনশক্তি ব্যবসায়ী নেতা এম টিপু সুলতান বলেন, প্রতিবাদে আমি একজন কর্মীও পাঠাইনি। টাকা বানাতে চাকরি না থাকার পরও কর্মী পাঠিয়ে বিপদে ফেলা হয়েছে।

একাধিক জনশক্তি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় ‘মার্কেটিং’ দালালরা বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠান থেকে চাহিদাপত্র এনে বিক্রি করেছে। মালয় নিয়োগকারী কাজ না থাকার পরও চাহিদাপত্র দিয়ে কর্মী নিয়েছে।

ভুয়া চাকরি দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের এ পদ্ধতি ‘এজেন্ট ভিসা’ বা সাপ্লাই ভিসা নামে পরিচিত। কুমিল্লার হৃদয় হোসেন বলেন, ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় গত আগস্টে মালয়েশিয়ায় এসে পরিচিতজনের মাধ্যমে কাজ খুঁজে নিয়েছি।

মালয়েশিয়া প্রবাসীদের ‘কাজের খবর’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। এর সদস্য ৭০ হাজার। গত এক সপ্তাহে গ্রুপটি ঘুরে দেখা যায়, হাজার হাজার প্রবাসী জানিয়েছেন তারা প্রতিশ্রুত চাকরি পাননি। শত শত কর্মী প্রতিদিন পোস্টে জানাচ্ছেন, ছয়-সাত মাস ধরে বেকার। আকুতি জানাচ্ছেন- বেতন যা-ই হোক, একটি কাজ দিতে।

যদিও প্রবাসীকল্যাণ সচিব রুহুল আমিন এ ভাষ্যকে অতিরঞ্জিত বলেছেন। কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনের বরাতে তিনি দাবি করেন, মাত্র ৫ হাজার ১৯০ কর্মী কাজ পাননি।

জনশক্তি খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ৫ হাজার ১৯০ জন হাইকমিশনে চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। প্রকৃত কাজ না পাওয়া কর্মীর সংখ্যা লাখের বেশি।

অভিবাসী উন্নয়ন কর্মসূচির (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটিই দুর্নীতিপূর্ণ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)