গ্রামীণফোন-রবির কর ফাঁকি ৩৭২ কোটি টাকা
ডেস্ক নিউজ:
মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও গ্রামীণফোন লিমিটেড ২০২০-২১ করবর্ষে ৩৭২ কোটি টাকা কম আয়কর দিয়েছে। এমন তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদফতরের ২০২৩ সালের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
রবি আজিয়াটা বলেছে, বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত নয়। আর গ্রামীণফোন বলেছে, এ ব্যাপারে তারা এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বার্তা পায়নি।
রাজস্ব অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন কর কমিশনার, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (আয়কর), ঢাকা কার্যালয়ের ২০২০-২১ করবর্ষে রবি আজিয়াটা ও গ্রামীণফোন প্রভিশনকৃত (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) অর্থসহ অন্যান্য অননুমোদনযোগ্য খরচ আয়ের সঙ্গে যোগ না করে মোট আয়কর নিরূপণ করেছে। এতে রবির ৩৬৫ কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকা এবং গ্রামীণফোনের ৬ কোটি ৪৩ লাখ ২ হাজার ৯০৪ টাকা কম আয়কর নিরূপণ হয়েছে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে এই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে গত ১০ জানুয়ারি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মো. নূরুল ইসলাম। শিগগিরই প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে। এরপর তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে।
সাবেক সিএজি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, গুরুতর আর্থিক অনিয়মগুলোই বার্ষিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। এরপর তা সংসদে ওঠে। পরে তা হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রে কমিটি যথাযথ ভূমিকা পালন করে না। এতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অর্থ আদায় হয় না। তিনি এসব অর্থ আদায়ে জোরালো ভূমিকা নিতে তাগিদ দেন।
নিয়ম অনুযায়ী, অডিট আপত্তির জবাব ব্রড শিটে চাওয়া হয়। এরপর জবাবগুলো নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকেও সমাধান না হলে সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
কোনোভাবেই আপত্তিগুলোর সন্তোষজনক জবাব ও প্রমাণ না পেলে তা চূড়ান্ত করে বার্ষিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়।
সিএজি কার্যালয় সূত্র বলছে, গত কয়েক বছর এই অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য একাধিক বৈঠক ও চিঠি চালাচালি হয়েছে। গ্রামীণফোন ও রবি এ বিষয়ে জবাব দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি রাজস্ব অডিট অধিদফতর। পরে আপত্তিগুলো চূড়ান্ত করে বার্ষিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সিএজি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি মূলত কর ফাঁকি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ করবর্ষে রবি আজিয়াটার মোট আয় ছিল ৬০ কোটি ৪১ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৫ টাকা। এর বাইরে ভবিষ্যতে পরিশোধের আশায় প্রভিশনকৃত অর্থ রাখা হয় ৯৮ লাখ ২০ হাজার টাকা, যা আয়ের সঙ্গে যোগ না করেই আয়কর নির্ধারণ করেছে কোম্পানিটি। এ ছাড়া ডিলারস কমিশন বাবদ খরচ করার দাবি করা হয়েছে ৭৮৯ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এ টাকার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটার প্রমাণ পায়নি নিরীক্ষা দল। সিকিউরিটি ও ক্লিনিং সেবার বিল ২১ কোটি ৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ওপর ২ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐ করদাতা প্রতিষ্ঠানের আদায়যোগ্য আয়কর ৫১৬ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৬৫ টাকা। কিন্তু তাদের নিরূপিত আয়কর ১৫০ কোটি ৯৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৫ টাকা। এতে ৩৬৫ কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে রবির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ জানায়, এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের কোনো তথ্যের বিষয়ে আমরা অবহিত নই।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ করবর্ষে গ্রামীণফোনের আয় দেখানো হয় ৬ হাজার ৬৫০ কোটি ৫ লাখ ৩ হাজার ৯৬৫ টাকা। তবে অ্যাসেট রিটায়ারমেন্ট অবলিগেশন (এআরও) খাতে ৮১ লাখ ১৬ হাজার টাকা রাখা হয়েছিল, যা মূল আয়ের সঙ্গে যোগ করেনি গ্রামীণফোন। এছাড়া পণ্য বিতরণ বা বিপণন বাবদ কমিশন, ছাড়, ফি ও প্রণোদনা ভাতা খাতে কম কর কর্তন করা হয়েছে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ৪১ হাজার ২৬০ টাকা। এআরও খাতের অর্থ এবং কর কম কর্তন করায় গ্রামীণফোনের ৬ কোটি ৪৩ লাখ ২ হাজার ৯০৪ টাকা আয়কর কম দেখানো হয়েছে। এ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ব্যাপারে আমরা এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো বার্তা পাইনি। তাই এ মুহূর্তে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। সংশ্লিষ্ট কর আইন মেনে চলতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রযোজ্য কর প্রদানে গ্রামীণফোন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সার্বিক বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, রাজস্ব আদায়ে আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। এগুলো তো রাষ্ট্রের টাকা, জনগণের টাকা। সেগুলো তাদের পরিশোধে বাধ্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমি অনুরোধ করবো, তারা যেন সব বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করে। এতে তাদের পলিসিবান্ধব সুবিধা দিতে পারবো।