বিনা বাধায় ঢুকছে কোটি টাকার ইয়াবা

ডেস্ক নিউজ:
অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে মাদক পাচার, বিক্রি ও সেবন। আকাশ, নৌ ও স্থল পথে অনেকটা বিনা বাধায় ঢুকছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য। প্রতি বছরই হাজার কোটি টাকার বেশি মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছে পুলিশ, র‍্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারপরও মাদকের পাচার বন্ধ হচ্ছে না। জিরো টলারেন্স নিয়ে দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলমান থাকা সত্ত্বেও ঢুকছে মাদক।

রোববার (১২ মে) বেলা ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অ্যাম্বুলেন্সে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ভেতর থেকে ৬০ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে আটক করেছে পুলিশ। উদ্ধারকৃত ইয়াবার আনুমানিক বাজার মূল্য ২ কোটি টাকা। উপজেলার মেঘনা টোল প্লাজা সংলগ্ন চেকপোস্ট এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্সটি। আটককৃত চালক মো. ইসহাক টেকনাফ এলাকার উত্তর নীলা আমতলী এলাকার বাসিন্দা মো. কামাল হোসেনের ছেলে।

জানা যায়, কক্সবাজার থেকে ঢাকায় প্রবেশের দুটি পথ রয়েছে। একটা হলো সোনাগাঁও আরেকটি হলো কাঞ্চন ব্রিজ। প্রতিদিন স্থল পথে বাসে, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকে করে দেশে আসছে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা।

প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত বলছেন, মাদকের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। তারপরও বিনা বাধায় মাদক আসছে। এর সঙ্গে জড়িত অনেকেই। কোটিপতি হওয়ার সহজ পথ হচ্ছে এটি। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক ছোটখাট অফিসার টেকনাফ ও পার্বত্যাঞ্চলে পোস্টিং নেন কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে। কারণ ওই টাকা তার তুলতে বেশি দিন লাগে না।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ। সারাদেশে কোমলমতি ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্কুল বাদ দিয়ে তারা মাদক ব্যবসা করছে। এক সময় যারা বেকার ঘুরে বেড়াতো, পূর্ব পুরুষের কিছুই ছিল না, তারা এখন এক একজন দামি ৪-৫টি গাড়ি ব্যবহার করেন। মাদকের টাকায় কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। দলীয় বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও মাদকের ব্যাপারে সবাই যেন ভাই ভাই। এর সঙ্গে জড়িত বড় বড় অনেক নেতা। সাবেক এমপি, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাও এই তালিকায় রয়েছে।

মাদকের টাকার ভাগ অনেকেই পান। অনেকেই নামে করেন সরকারি দল, আসলে তারা দলের কেউ না। করেন ইয়াবা ব্যবসা। প্রতি এলাকায় এক শ্রেণীর নেতারা এটাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ছেলেরা ফেল করে কেন, কিশোর গ্যাং কেন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না- এমন প্রশ্ন তুলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক বহন করে কিশোর গ্যাং। তাদের মোটরসাইকেল ও অস্ত্র আছে। তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে মাদক। মাদকের সঙ্গে যারা থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক সময় থাইল্যান্ডে এমন অবস্থা ছিল। হাটে-বাজারে ছিল মাদকের ছড়াছড়ি। তখন থাইল্যান্ডের রাজা ২০ পিসের নিচে কারো কাছে ইয়াবা পাওয়া গেলে যাবজ্জীবন এবং ২০ পিসের বেশি থাকলে ‘ক্রশফায়ার দিতে’ শুরু করেন। মাত্র এক মাসে ৫ শতাধিক লোক মারা গিয়েছিল। এখন থাইল্যান্ডে মাদক সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই ধরনের ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে না- এমনটি মনে করেন অনেকেই।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে এক শ্রেণীর কর্মকর্তারাও জড়িত। অর্থের লোভে তারা যে নিজের সন্তান ও পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সেটা যেন তারা বুঝতে পারছেন না। মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনজীবীদেরও দায়িত্ব আছে। প্রমাণসহ অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে হাতেনাতে গ্রেফতার করার পরও আইনজীবীরা তার পক্ষে দাঁড়ায়। জামিনে বেরিয়ে এসে সেই লোক আবার মাদক ব্যবসা করে। এদের জামিনও হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেরই নিজের সন্তান রক্ষার জন্য যে দায়িত্ব পালন করতে হয়, মাদক নিয়ন্ত্রণে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। নইলে কিশোর গ্যাং ও ইয়াবা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে- এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ।

কক্সবাজারের সাবেক একজন সংসদ সদস্যসহ এক ডজন মাদকের গডফাদার রয়েছেন। এ কারণে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নাফ নদীর ওপারে রয়েছে ইয়াবার কারখানা। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে, কিন্তু ইয়াবা কারখানা অক্ষত রয়েছে। ইয়াবা তৈরিও হচ্ছে। প্রতিদিনই আসছে ইয়াবা।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃত মো. ইসহাক স্বীকার করেছেন, এর আগেও এই পদ্ধতিতে একাধিকবার মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, আটককৃত মো. ইসহাককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম বলেন, সব জায়গায় চেকপোস্ট রয়েছে। তবুও চট্টগ্রাম থেকে দুই পথে মাদক আসে ঢাকায়।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি। আমাদের কার্যক্রম আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আমরা বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এতো বড় সীমান্ত, সেখান থেকে ঢোকে। নদীতে শত শত ট্রলার থাকে। আমাদের পক্ষ থেকে যা করা দরকার করে যাচ্ছি।

র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি শতভাগ বাস্তবায়ন করতেই হবে। নইলে সমাজ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। নৌপথ, স্থল পথ ও আকাশ পথে ব্যাপক হারে আসছে মাদক। মাদক দেশের আনাচে-কানাচে ব্যবহার হচ্ছে। উঠতি বয়সীরাই বেশি ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধে অল আউট প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একটিমাত্র সংস্থার পক্ষে এটা সম্ভব না। সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)