ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব সর্বত্র, বাড়বে খরচ
ডেস্ক নিউজ:
দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল করতে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়, এ নীতি অনুসরণ করা হলে ডলার সংকট কেটে যাবে। বিনিময় হারজনিত অস্থিরতাও হ্রাস পাবে। যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতা দিচ্ছে ভিন্ন তথ্য। বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। জটিল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এর প্রভাব পড়বে সর্বত্র। বাড়বে ঋণের খরচও।
গত মার্চেই বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এখন ডলারের দাম বেড়ে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় সুদ ও আসল পরিশোধে আগের চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করতে হবে। আর এতে সব মিলিয়ে সামনে অর্থনীতির আরো বিপদ দেখছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।
নতুন নীতির কারণে ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ টাকা থেকে ১১৭ টাকা হয়েছে। আর খোলা বাজারে ১১৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। ফলে ডলার প্রতি ঋণের খরচ এক দিনেই সাত টাকা বেড়ে গেল। বিদেশি ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধ করতে চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। ডলারের হিসাবে যা ৪৮ শতাংশ বেশি। ডলারের দাম নতুন করে আরেক দফা বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ তৈরি হলো। শুধু মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণেই সমপরিমাণ সুদাসল পরিশোধে বেশি টাকা দরকার হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের(সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বিদেশি ঋণ ও সুদ তো ডলারে শোধ করতে হয়। আর এই ডলার তো টাকার বিনিময়ে কিনতে হয়। তাই যখন ঋণ নেয়া হয়েছে সেই সময়ে ডলারের দাম যা ছিলো তার থেকে যতটুকু টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে তত টাকা বেশি খরচ হবে।
গত অর্থবছর শেষে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিন গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে। শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বলছে, গত জুলাই ডিসেম্বরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৪৯ ভাগ। ঐ ছয় মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) একই সময়ে যা ছিল ১০৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৪৮.৮২ ভাগ। আগামী অর্থবছরেও এটা ৬৩ শতাংশ বাড়তে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থ বছরে(২০২৩-২৪) মোট আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হবে ৩২৮ কোটি ডলার। আগামী অর্থ বছরে যার পরিমাণ হবে ৪০০ কোটি ডলার। ডলারের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিক কারণেই এখন ঋণ ও সুদ পরিশোধের জন্য বেশি টাকা খরচ করতে হবে। কারণ এই ডলার তো দেশি মুদ্রায় সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
ঋণের সুদ ও আসল পরিধোধের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। ২০২৯-২০৩০ সালে যা হবে ৫১৫ কোটি ডলার। টাকার যত অবমূল্যায়ন হবে এই ঋণ পরিশোধের খরচ ততই বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এখন দেড় লাখ টাকা থেকে আরো বেড়ে গেল। দেড় লাখ টাকা ছিলো ডলারের দাম ১১০ টাকা হিসাবে। মাত্র তিন বছর আগে মাথাপিছু ঋণ ছিলো এক লাখ টাকা।
অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন ঘটবে। আমরা দেখতে পাবো বিদেশি ঋণ এবং সুদ পরিশোধে আমাদের আগের চেয়ে আরো বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। টাকার যত অবমূল্যায়ন হবে ঋণের খরচ তত বাড়বে। আর রিজার্ভের ওপরও প্রভাব বাড়বে। কারণ আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। গত দুই বছরে রিজার্ভ কমে আগের তুলনায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আর প্রতি মাসেই কমছে। এই কারণে আইএমএফও রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার করে দিয়েছে।
তার কথায়, তবে ডলারের দাম বাড়ার একটা সুবিধা আছে। আর তা হলো যদি এই কারণে রফতানিকারকরা উৎসাহিত হন। বেশি রফতানি করেন। তাহলে ডলার প্রবাহ বাড়তে পারে। তবে আবার ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ তো বেড়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো গেলেও ডলারের জোগান বাড়বে।
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ডলারের দাম কমিয়ে ৮০-৮৫ টাকা রাখা হয়েছিল। ডলারের দাম কম দেখিয়ে বিদেশ থেকে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পে বেশি ডলার খরচ করা হয়েছে। এখন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার হিসাবে আরো বেশি শোধ করতে হবে। সেটা ২৫ থেকে ৪০ ভাগ বেশি।
তিনি বলেন, এই টাকা জোগাড় করতে হলে রাজস্ব আয় অনেক বাড়াতে হবে। অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। তাতেও না হলে কাগুজে মুদ্রা ছাপতে হবে। এর প্রভাব বাজারে নানা দিক দিয়ে পড়বে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
তার কথায়, অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হয়। তা না করে এতদিন অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চালানো হয়েছে। এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এর জন্য মূল্য দিতে হবে।
সরকার এই পরিস্থিতিতে আরো ঋণ করতে চাইছে। আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির ১১৫কোটি ডলার পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক থেকে মোট ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা চাইছে সরকার। এডিবির কাছে ৬৫ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। এর বাইরে এআইআইবি ও ফ্রান্স সাহায্য সংস্থার কাছে ৭০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। এছাড়া চীনের কাছ থেকেও বড় অঙ্কের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সরকার এখন ঋণ করে বিদেশি ঋণ পরিশোধের দিকে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতি। আর ডলারের দাম বাড়ায় ঋণের খরচ বাড়তেই থাকবে। এখন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রকল্প আর নেয়া ঠিক হবে না। প্রকল্পের খরচ কমাতে হবে।
তার কথায়, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এর সঙ্গে ঋণের খরচ আরো বেড়ে অর্থনীতি আরো জটিল হবে।