অনলাইনে ভোগান্তি, হাতে হাতে নেয়া হচ্ছে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের ফি

ডেস্ক নিউজ:
গেল বছরের মে মাস থেকে সারা দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদনের ফি অনলাইনে অর্থাৎ ই–পেমেন্টের মাধ্যমে নেয়া শুরু হয়। পরে নানা জটিলতায় এটি হয়ে ওঠে ‘ভোগান্তির’ আরেক নাম। সনদ পেতে লোকজনকে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়েছে। বিশেষ করে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভোগান্তি ছিল চরমে। নিবন্ধনের জন্য গেলেই লোকজনকে শুনতে হতো ‘সার্ভার ডাউন’। পরে এই সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষ ছয় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে এই সেবা। আবেদনকারী ব্যক্তিরা স্থানীয় নিবন্ধক কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন ফরমের সঙ্গে হাতে হাতে ফি (ম্যানুয়াল পেমেন্ট) জমা দিচ্ছেন।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধনের চাপ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে আইবাস‍+‍+ প্রক্রিয়া সামাল দিতে না পারায় ই–পেমেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব কাজী সাইফুদ্দিন হোসেনের পারিবারিক প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধন করার দরকার হয়। গত সপ্তাহে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে আবেদন ফরম জমা দেন।

একই এলাকার আরেফিন আমিন রোহান (১৯) তার নিজের ও মা–বাবার নাম সংশোধনের আবেদন জমা দিয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি জন্মনিবন্ধন করেছিলেন। আবেদনকারী দুজনই অনলাইনে আবেদন করার পর আবেদনের কপি নিয়ে নিবন্ধক কার্যালয়ে এসে নির্ধারিত ৫০ টাকা ফি দিয়েছেন। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের স্থানীয় নিবন্ধকের দায়িত্ব পালন করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।

৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম বলেন, কয়েক মাস ধরে ই–পেমেন্ট পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। যারা আবেদন করছেন, তারা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে এসে হাতে হাতে ফি দিচ্ছেন। চালানের মাধ্যমে সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হচ্ছে।

‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের’ তথ্য অনুসারে, ৬ মে এক দিনে ম্যানুয়াল পেমেন্ট হয়েছে ৫৮ হাজার ৭৪৯টি। ঐ দিন জন্ম ও মৃত্যুর নতুন আবেদন ও সংশোধনসহ মোট আবেদন ছিল ৬৯ হাজার ৯০৮টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৩২ লাখ ৯২ হাজারের বেশি জন্মনিবন্ধন ও ২ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে।

গত বছরের মে মাস থেকে সারা দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদনের ফি অনলাইনে অর্থাৎ ই–পেমেন্টের মাধ্যমে নেয়া শুরু হয়। এর আগে গত বছরের ৪ এপ্রিল মেহেরপুর পৌরসভা ও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমবার পাইলট আকারে ই–পেমেন্ট শুরু হয়।

ই–পেমেন্টের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাস++ এ যায়। আইবাস+‍+ (ইন্টিগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম) হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা। এটি ইন্টারনেটভিত্তিক সফটওয়্যার। যার মাধ্যমে সরকারের বাজেট প্রণয়ন, বরাদ্দ, বিভাজন, অর্থ অবমুক্তি, বাজেট পুনঃ উপযোজন, অনলাইনে বিল দাখিল এবং তার বিপরীতে চেক বা ইএফটির (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) মাধ্যমে অর্থ প্রদান, রাজস্ব জমার হিসাবরক্ষণ, স্বয়ংক্রিয় ব্যাংক হিসাব সমন্বয় ইত্যাদি আর্থিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা হয়।

গত বছর জন্মনিবন্ধন ছিল বছরের অন্যতম ‘ভোগান্তির’ নাম। সনদ পেতে লোকজনকে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়েছে। বিশেষ করে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভোগান্তি ছিল চরমে। নিবন্ধনের জন্য গেলেই লোকজনকে শুনতে হতো ‘সার্ভার ডাউন’। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সিস্টেমের (https://bdris.gov.bd/br/application) ধারণক্ষমতা কম থাকায় আবেদনের অতিরিক্ত চাপে সিস্টেমে ধীরগতি (সার্ভার ডাউন নামে বেশি পরিচিত) দেখা দিত। সার্ভারের দুর্বল ব্যবস্থাপনার মধ্যে গত বছরের ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চে বাংলাদেশের সরকারি একটি ওয়েবসাইট (রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়) থেকে কয়েক লাখ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এ খবর প্রকাশের পর অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য ব্যক্তির নিজে আবেদন করার সুযোগ গত আগস্ট মাসজুড়ে বন্ধ থাকে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ গত বছরের ২৬ নভেম্বর থেকে ম্যানুয়াল পেমেন্ট শুরু করে এবং এর সুফল পেতে থাকে। ৩০ নভেম্বর থেকে ই–পেমেন্ট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নভেম্বরে নিবন্ধন সংখ্যা বেড়ে ছয় লাখে পৌঁছায় এবং ডিসেম্বরে তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

ই–পেমেন্ট বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন বলেন, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নতুন ও পুরোনো আবেদন সংশোধনসহ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে দিনে গড়ে লাখখানেক লেনদেন হয়। আইবাস‍+‍+ এত বেশি চাপ নিতে পারছিল না। আবেদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ই–পেমেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ম্যানুয়াল পেমেন্ট চলবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে ফি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ম্যানুয়াল এবং অনলাইন দুটি পদ্ধতিই চালু রাখার চিন্তাভাবনা চলছে।

ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড সচিব জাহিদ ফেরদৌস বলেন, এখন আর আগের মতো ‘সার্ভার ডাউন’ থাকছে না। মাঝেমধে দু–এক দিন ডাউন থাকে। তাদের কার্যালয়ে দিনে ১০–১২টি নিবন্ধনের আবেদন জমা পড়ে।

তবে শুধু ই–পেমেন্ট বন্ধ করে সার্ভারের গতি বাড়েনি বলে মন্তব্য করেছেন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, অন্যান্য ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এপ্রিলে সিস্টেমের ধারণ ক্ষমতা ৭২ টেরাবাইট থেকে বাড়িয়ে ৩২২ টেরাবাইট করা হয়েছে। আবেদন ফরমের সঙ্গে প্রয়োজনীয় নথি যুক্ত করার জন্য ১০০ কিলোবাইট জায়গা রাখা হয়েছিল। সেটি বাড়িয়ে ২ মেগাবাইট করা হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)