কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে জেলিফিশ
ডেস্ক নিউজ:
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে কয়েক সপ্তাহ ধরে অসংখ্য জেলিফিশ ভেসে আসছে। এসব জেলিফিশ শরীরে লাগলেই একদিকে যেমন চুলকানি হচ্ছে। মৃত জেলিফিশ পচে গিয়ে সৈকত এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অস্বাভাবিক সংখ্যায় জেলিফিশ ভেসে ওঠায় স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরার জাল ফেলতে পারছেন না বলে অভিযোগ করছেন। কিন্তু হঠাৎ এত জেলিফিশ ভেসে আসার কারণ কী?
গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে থেকে সমুদ্র সৈকতে ঝাঁকে ঝাঁকে জেলিফিশ ভেসে আসছে বলে জানিয়েছেন কুয়াকাটার স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, এর আগেও কমবেশি ভেসে আসতো। তবে গত কয়েক সপ্তাহে এর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে।
জাল ফেললেই দেখা যাচ্ছে তাতে শত শত জেলিফিশ আটকাচ্ছে। জালের ওজন বেড়ে যাওয়ায় অনেক সময় তা টেনে নৌকায় তুলতে পারছেন না জেলেরা। ফলে জাল কেটে ফেলতে হচ্ছে। সৈকতে আটকে থাকা জেলিফিশ মরে-পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয়রা তা বালির নিচে পুঁতে দিচ্ছেন।
তারা আরো বলেন, জেলিফিশগুলোর আকার বেশ বড় এবং একেকটির ওজন কয়েক কেজি। হাফ কেজি থেকে শুরু করে তিন-চার কেজি ওজনেরও জেলিফিশ ভেসে আসছে।
জেলিফিশ আসলে কী?
জেলিফিশ এক ধরনের বহুকোষী জলজ প্রাণী। নামের সঙ্গে ‘ফিশ’ যুক্ত থাকলেও শরীরে মেরুদণ্ড বা হাড় না থাকায় একে ঠিক মাছ হিসাবে গণ্য করেন না বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ৫০০ কোটি বছর আগে জেলিফিশের জন্ম হয়েছিল, যা ডাইনোসর যুগেরও আগের ঘটনা। জেলিফিশের মস্তিষ্ক, এমনকি হৃদপিণ্ডও নেই। তবে এদের শরীর জুড়ে অসংখ্য স্নায়ু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করেই এটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় শ্বাস নিয়ে থাকে। জেলিফিশের শরীরের প্রায় ৯৮ শতাংশই পানি দিয়ে গঠিত।
মাছের মতো আঁশ, ফুলকা বা পাখনাও থাকে না। এরা মূলত লবণাক্ত পানিতে বাস করে। সমুদ্রের ১২০০০ ফুট গভীরেও এদের খুঁজে পাওয়া যায়। আকৃতিতে সাত ফুট থেকে শুরু করে ১২০ ফুট পর্যন্ত বড় হতে পারে। এক্ষেত্রে একেকটা জেলিফিশের ওজন আট থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। জেলিফিশ সাধারণত মাছের ডিম, রেণুপোনা, প্লাঙ্কটন এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জলজ প্রাণি খেয়ে বেঁচে থাকে। যৌন এবং অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই এরা বংশবিস্তার করতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীতে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রে তিন থেকে চার প্রজাতির জেলিফিশ দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ‘সাদা জেলি ফিশ’। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে মূলত এই প্রজাতির জেলিফিশ ভেসে আসছে।
জেলিফিশের শরীরের প্রায় ৯৮ শতাংশই পানি দিয়ে গঠিত -ছবি: সংগৃহীত
জেলিফিশের শরীরের প্রায় ৯৮ শতাংশই পানি দিয়ে গঠিত -ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলেও জেলিফিশ দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে একে ডাকা হয় ‘নুইন্না’। কারণ এর শরীরের বেশিরভাগ অংশ লবণাক্ত পানি দিয়ে তৈরি। জেলিফিশ বেশি পাওয়া যায় বলে কক্সবাজারের একটি এলাকার নামই দেওয়া হয়েছে ‘নুইন্নাছড়া’। প্রজাতিভেদে জেলিফিশ কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বেশ কিছু দেশে জেলিফিশের কয়েকটি প্রজাতি খাওয়া হয়। তবে বাংলাদেশি সাধারণত কাউকে এটি খেতে দেখা যায় না। তবে এটি বিদেশে রপ্তানি করা যায় কী-না, সেটি নিয়ে সম্প্রতি গবেষকরা শুরু করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।
হঠাৎ এত জেলিফিশ আসার কারণ কী?
গবেষকরা বলছেন, শীতের শেষে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ খানিকটা বেড়ে যায়। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব ভালো থাকে, যা জেলিফিশের বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত সময়। আবার সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রধান খাদ্য এসব জেলিফিশ।
জেলিফিশ কী বিষাক্ত?
গবেষকরা বলছেন, হাজারো প্রজাতির জেলিফিশের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে, যেগুলো কিছুটা বিষাক্ত। তবে সেই বিষ মৃত্যু ঘটানোর মতো নয়।
পটুয়াখালী জেলার মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, বিষাক্ত জেলিফিশের সংস্পর্শে আসলে বড়জোর চুলকানি, লাল বার্ন হয়ে যাওয়া বা চোখে লাগলে ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশে বিষাক্ত জেলিফিশ খুব একটা দেখা যায় না। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যে সাদা জেলিফিশ দেখা যাচ্ছে, সেটিও নির্বিষ। তারপরও এটি শরীরে লাগলে কিছুটা চুলকানির মতো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এতে ভয়ের কিছু না থাকলেও জেলিফিশের সংস্পর্শে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কুয়াকাটার সমুদ্র উপকূলে জেলিফিশকে কেন্দ্র করে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা। মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, এটি একটি সাময়িক সমস্যা। সমুদ্রের পানিতে তাপমাত্রা কমে গেলেই এটি চলে যাবে। বৃষ্টিপাত হলেই সমুদ্রের তাপমাত্রা কমে আসবে।