তালায় চাকুরির টাকা ফেরৎ চাওয়ায় মেয়েকে দিয়ে শ্লীলতাহানির মামলা

রঘুনাথ খাঁ ঃ চাকুরি না হওয়ায় টাকা ফেরৎ চাওয়ায় শিক্ষক সুভাষ দাসকে নির্যাতন ও নির্যাতনকারির চতুর্থ শ্রেণীতে পড়–য়া মেয়েকে দিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শনিবার বিকেলে ওই শিক্ষককে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষক সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ও নুরুল্লাহপুর গ্রামের নিতাই চন্দ্র দাসের ছেলে।
তালা উপজেলার নুরুল্লাহপুর গ্রামের সুভাষ চন্দ্র দাসের বড় মেয়ে রমা রাণী দাস জানান, তার বাবা কর্মজীবনের প্রথম দিকে কারিতাসের পরিচালনাধীন ফিডার স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সরকারিভাবে বিদ্যালয় তৈরির ঘোষণার পর তার ঠাকুর দাদা নিতাই দাসের দান করা এক বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ফতেপুর রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ওই বিদ্যালয়ের নিবন্ধন হয়। ২০১৩ সালে ফতেপুর রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করা হয়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তার বাবা সুভাষ চন্দ্র দাস প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সুকুমার দাস ও ইস্টম দাসের অনুরোধে জমি দাতা হিসেবে বাবা ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাদের নিবন্ধন করান। অথচ ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ সিরাজুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অন্যত্র চলে যাওয়ায় জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে কৌশলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হন ইস্টম দাস।
রমা রানী দাস আরো বলেন, তিনি দুই বার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগের লেখা পরীক্ষায় পাস করলেও মৌখিক পরীক্ষায় টিকতে পারেননি। একপর্যায়ে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরাতন পরীক্ষার্থী যারা মৌখিক পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় সূযোগ দেওয়া হবে এমন কথা বলে তার সঙ্গে ১৫ লাখ টাকা ঘুষের চুক্তিতে প্রথমে এক লাখ টাকা দাবি করেন শিক্ষক ইস্টম দাস। চাকুরি হলে তাকে বাকী ১৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। একপর্যায়ে গত বছরের ১৫ জানুয়ারি শ্বশুর বাড়ির সোনার গহনা তালা বাজারের রাধা গোবিন্দ জুয়েলার্সে বন্ধক রেখে এক লাখ টাকা নিয়ে বাড়িতে ডেকে বাবা ও পরিবারের সদস্য ছাড়া প্রতিবেশি দু’কাকার উপস্থিতিতে ইস্টম দাসের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে চাকুরি দেওয়া না হলে টাকা সুদাসলে ফেরৎ দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন ইস্টম দাস। চাকুরি না হওয়ায় টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করায় ইস্টম ও তার স্ত্রী অঞ্জলী দাসের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের চিড় ধরে। একপর্যায়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে তাকে ৫০ হাজার টাকা ফিরিরে দেন ইস্টম দাস। নিজের চিকিৎসার জন্য পাসপোর্টে ভারতে যেতে হলে তাকে টাকা ফিরিয়ে দিতে বললে তাদেরকে দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে আসছিলেন ইস্টম দাস।
স্থানীয় কার্তিক দাস. রজনী দাসসহ কয়েকজন জানান, রুপ লাবন্যময়ী মায়া মমতায় ঘেরা অঞ্জলী দাস দীর্ঘদিন খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান সাহেবের বিশেষ কাজ করে দেওয়ার কারণে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে। প্রতিবেশি আকাশ দাসসহ অনেকের সাথে রয়েছে তার গভীর সখ্যতা। একপর্যায়ে ইস্টম দাস ও স্ত্রী অঞ্জলী দাস চাকুরি দেওয়ার কথা বলে ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিদ্দিকুর রহমানের ভাই আনিসুর রহমান আনের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা, তেঁতুলিয়ার আব্দুল বারির ছেলে সোহান আহম্মেদ ইমনকে জেল পুলিশে চাকুরি দেওয়ার নাম করে ১৫ লাখ টাকা, তারাপদ দাসের ছেলে রঞ্জু দাসকে চাকুরি দেওয়ার নাম করে ছয় লাখ টাকা, বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার নাম করে দীপঙ্কর ঘোষের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকাসহ কমপক্ষে এক ডজন লোককে চাকুরি দেওয়ার নাম করে দুই কোটিরও বেশি টাকা প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। টাকা ফেরৎ চাওয়ায় সুভাষ দাসকে শায়েস্তা করতে ইস্টম পরিবারের কাছের মানুষ আকাশকে দিয়ে নির্যাতনের পর পরিকল্পিতভাবে শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নুরুল্লাহপুর গ্রামের ছায়া রানী দাস বলেন, গত ১০ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় তার স্বামী সুভাষ দাস বিদ্যালয়ের মাঠে পৌঁছানোর পর তাকে অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে যান প্রতিবেশি প্রদীপ দাসের ছেলে আকাশ দাস। এরপারপরই দরজা আটকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইস্টম দাসের সামনে তাকে বেধরড়ক পেটান আকাশ দাস ও তার ভাই বিকাশ দাস। পাঁচ মিনিট ব্যাপি মারপিটের ফলে চশমার ফ্রেম ভেঙে চোখের কোনে ও নাকের উপরে ঢুকে রক্তাক্ত জখম হয়। এরপর দরজা খুলে আকাশ ও বিকাশ বেরিয়ে আসলে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে স্থানীয় সুবোল দাস, তার ছেলে মহাদেব দাস, মহাদেবের স্ত্রী পুজা দাস, ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা সাঈদা খানমসহ কয়েকজন সুভাষের কথা শুনে মারপিটের প্রতিবাদ করেন। এতে ক্ষুব্ধ আকাশ বাঁশের লাঠি নিয়ে তাদেরকে মারতে যান। একপর্যায়ে লোকজন বেশি এসে পড়ায় সেখান থেকে চলে যায় আকাশ ও বিকাশ। জানতে চাইলে তার চতুর্থ শ্রেণীর মেয়েকে সুভাষ দাস গত ৭ মার্চ বৃহষ্পতিবার দুপুর ১২টার পর অফিস কক্ষে শ্লীলতাহানি করেছে বলে জানায় আকাশ। এরপর সুভাষ বিষয়টি অফিসে যেয়ে তার ক্লাস্টার (এটিও) সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অসীম সরকার, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সূর্যপদ পালকে অবহিতে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়। পরদিন ১১ মার্চ সুভাষ থানায় ৪২৯ নং সাধারণ ডায়েরী করেন। ১২ মার্চ তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিনই যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরবর্তীতে যথাযথ তদন্ত না করে গত ১৫ মার্চ শুক্রবার রাত ১২টার পরে পুলিশ বাড়ি থেকে ডেকে থানায় নিয়ে পরদিন আকাশ দাসের শিশু কণ্যাকে শ্লীলতাহানির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছে।
ইসলামকাটি ১০৫ নং আদর্শ সরকাারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক জানান, ৯ মার্চ গোপালপুর বলাই ঘোষের আমবাগানে পিকনিক উপলক্ষে ৭ মার্চ থেকে গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালেয় কারিকুলাম উন্নয়নের জন্য ‘উত্তরণ’ নাটক মঞ্চস্ত হওয়ার কথা ছিলো। তাতে ভাত চোর এর দৃশ্য মঞ্চস্ত করার জন্য সুভাষ দাসকে মনোনীত করা হয়। সে অনুযায়ি নির্দেশনা পেয়ে সুভাষ দাস ৭ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় হাজিরা খাতায় সাক্ষর দিয়ে ১০টায় বের হয়ে সাড়ে ১০টায় গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিহার্সসালে আসেন। ওই রিহার্সসালে ২০ জন প্রধান শিক্ষকসহ ২৬ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। রিহার্সসালের সকাল ১১টা ৪৮ মিনিট, ১১ টা ৫৬ ও ১১ টা ৫৮ মিনিটের ভিডিও ও স্থির চিত্র ধারণ করে তা নিজের ফেইসবুকে পোষ্ট করেন ইসলামকাটি আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সঞ্জয় ঘোষ। সুভাষ দাসসহ তারা সকল শিক্ষক ওই দিন বিকেল সাড়ে তিনটার সময় চলে যান।
তালা উপজেলা সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অসীম কুমার সরকার জানান, ১২ মার্চ তার চতুর্থ শ্রেণীর পড়–য়া মেয়েকে শিক্ষক সুভাষ দাস অফিস কক্ষে ডেকে শ্লীলতাহানি করেছে মর্মে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর এক অভিযোগ করলে তিনি ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরদিন তদন্তে যান। সেখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইস্টম দাস বলেন, যে, সুভাষ দাস হাজিরা খাতায় সাক্ষর করেই ১০ টার সময় গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয়ে রিহার্সসালে যান। তার সামনে আকাশ ১০ মার্চ সাড়ে ৯টার দিকে সুভাষ দাসকে মারপিট করেছিলেন বলে নিশ্চিত করেন। তবে পুলিশের কাছে দেওয়া লিখিত প্রতিবেদনে ইস্টম দাস লেখেন যে সুভাষ দাস ৭ জানুয়ারি সকাল সোয়া ৯টা থেকে সোয়া চারটা পর্যন্ত হাজির ছিলেন মর্মে সাক্ষর করলেও তিনি দুপুর একটার পর চলে যান। যিনি রিহার্সসালে সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত হাজির ছিলেন মর্মে উপস্থিত শিক্ষক ও ভিডিও চিত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে সেখানে ইস্টম দাসের লিখিত বক্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তাদের মনে হয়। সে অনুযায়ি আকাশ দাসের ৭ মার্চের সোয়া ১২টার তার মেয়েকে সুভাষ দাসের শ্লীলতাহানির বিষয়টি ধোপে টেকে না এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি মনে করেন।
ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সাঈদা খানম জানান, ৭ মার্চ গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয়ে রিহার্সালে অবস্থানকারি সুভাষ দাসকে বিদ্যালয় চলাকালিন সময়ে প্রদান শিক্ষকের উপিস্থিতিতে তার সামনে যেভাবে আকাশ দাস ও বিকাশ দাস পিটিয়েছে তা ক্ষমার অযোগ্য। এরপরও কোথাও কোন অভিযোগ না করে ১০ মার্চ পরিকল্পিতভাবে যেভাবে সুভাষ দাসকে পেটানো হলো সেজন্য শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ করা উচিত হামলাকারির বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে ইস্টম দাস তার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে চাকুরি দেওয়ার নামে সুভাষ দাসের বড় মেয়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা নেওয়াসহ কারো কাছ থেকে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, আকাশের সঙ্গে তাদের পারিবারিক মধুর সম্পর্ক থাকলেও সেটা কোন খারাপ কিছু নয়। সুভাষ দাসকে বাঁচাতে তার পরিবারের সদস্যরা তার ও তার স্ত্রীর নামে মিথ্যাচার করছে। তবে সুভ্ষা দাস ঠিক ক’টার সময় বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তা তার সঠিক মনে ছিল না বলেন জানান।
এ ব্যাপারে ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দু’ বছরের বেশি ধরে মেয়াদউত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য ছিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তালা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে বার বার চেষ্টা করেও তিনি পোন রিসিভ করেননি।
তালা থানার উপপরিদর্শক মনিরুজ্জামান জানান, ১৬ মার্চ আকাশ দাসের দায়েরকৃত মামলার আসামী সুভাষ দাসকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ভিকটিম ওই শিশু ১৬ মার্চ বিচারিক হাকিম নয়ন বিশ্বাসের কাছে ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তবে রবিবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত তিনি জবানবন্দির কপি পাননি।
তালা থানার পুলিশ পরিদর্শক মোল্লা মোঃ সেলিম জানান, স্পর্শকাতর মামলা এটি। যতাযথ তদন্ত করে পরবর্তীতে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

 

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)