শার্শায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ
মো: সাগর হোসেন: যশোরের শার্শায় অবাধে একের পর এক অবৈধ ইট ভাটা নির্মাণ আর বালু উত্তোলনে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশের ভারসাম্য। অবৈধ মাটি ও ইটবাহী যানবাহনের চাপায় প্রতিনিয়ত জীবন ঝরছে মানুষের। এতে উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এদিকে বছরের পর বছর এ অবস্থা শার্শার সব কটি ইউনিয়নে বিরাজ করলেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। অভিযোগ রয়েছেন সংশিষ্টদের ঘুষ বানিজ্যে এর প্রতিকার হচ্ছেনা। তবে উপজেলা প্রশাসন এসব কর্মকান্ডের বিষয়টি স্বিকার করে বলছেন দ্রুত এসব অনিয়ম রোধে আরো শক্তভাবে কাজ করবেন তিনি।
মনির হোসেন নামে স্থানীঅয় বাসিন্দা বলেন, কৃষি জমির পাশে ইট ভাটা থাকলে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় ও জীব বৈচিত্র ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়া নিয়ম না মেনে বালু উত্তোলনে যে কোন সময় ভুমি ধসের ঘটনাও ঘটতে পারে। এতে এসব ইট ভাটা নির্মান বা বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে নিয়ম মানতে হবে।
উপজেলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ ডিসেম্বর নয়ন কুমার রাজবংশী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে যোগদান করলেও এখন পর্যন্ত কোন অবৈধ স্থাপনা, অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তিনি কোন অভিযান পরিচালনা করেননি। অভিযোগ আছে প্রভাবশালীরা উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দেদারছে বালু, মাটি উত্তোলন, ইটভাটা, করাতকল, ক্লিনিক পরিচালনা করে আসছে। শার্শা উপজেলা ব্যাপী অবাধে চলছে অবৈধ ১৯টি ইটভাটা। অনুসন্ধানে জানা গেছে ১৯টি ইটভাটার না আছে পরিবেশ ছাড়পত্র, না আছে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন। এরপরও শার্শায় কোন অদৃশ্য শক্তিতে এসব অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। একাধিক ভাটা আছে সরকারি স্কুল ও আবাসিক এলাকার মধ্যে। গত বছর ১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট দেশের সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে জেলা প্রশাসকদের ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চললেও শার্শা উপজেলাতে চিত্র ভিন্ন। এখানে প্রশাসন অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। এছাড়াও আবাসিক এলাকার মধ্যে অবৈধ করাতকল থাকলেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা ব্যাপি চলছে মাটি বালু উত্তোলনের মহাউৎসব কোন অভিযান না থাকার কারনে কৃষি জমি থেকে প্রথমে গভীর করে মাটি উত্তোলন করে ইটভাটার চাহিদা মিটাচ্ছে। হাওর বাওর ও গভীর পুকুর থেকে দেদারছে চলছে বালু উত্তোলন।
বেনাপোল পৌরসভার বাহাদুরপুর রোড়ের বাসিন্দা ফারুক আহম্মেদ জানান,দীর্ঘ বছর যাবৎ বাহাদুরপুর রোড়ে আবাসিক এলাকার প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত আলামিন স-মিল চালানোর কারনে স-মিলের বিকট শব্দ ও কাঠের গুড়ার কারনে অতিষ্ট এলাকাবাসী। একাধিকবার পৌরসভা সহ উপজেলা প্রশাসনের নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি। বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়পুরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন জানান, সজনের ঘেরের পাশে ফসলি জমি থেকে বালু উত্তোলন করে বাড়ির পাশ দিয়ে দিনে ও রাতে দেদারছে বালুবাহী ট্রাক্টর-ট্রলি চলাচলের ফলে ধুলাবালির কারনে অতিষ্ট গ্রামবাসি। রাতেও ঘুমাতে পারছেন না এমনকি স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে। উপজেলা প্রসাশনের কোন তদরকি না থাকায় সাধারন মানুষ ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
বাহাদুরপুর ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থান বাহাদুরপুর বাঁওড় থেকে জনসম্মুখে মেইন রডের সাথে ব্রীজের পাশে দেদারসে বালু উত্তোলন করে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। এছাড়াও শার্শা উপজেলার গোগা ইউনিয়ন, কায়বা ইউনিয়ন, পুটখালী ইউনিয়ন, বাঁগআচড়া ইউনিয়ন, লক্ষণপুর ইউনিয়ন, শার্শা ইউনিয়ন, উলশী ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন স্থানে অবাধে মাটি এবং বালু উত্তোলন করার একাধিক অভিযোগ থাকলেও নেই কোন কার্যকরী পদক্ষেপ। এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নয়ন কুমার রাজবংশীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমিও এমন কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি এবং কয়েকটি ইটভাটার সাথে কথা বলেছি তারা জানিয়েছেন বর্তমানে লাইসেন্স বন্ধ থাকায় তারা লাইসেন্স করতে পারছেন না। আর মাটি এবং বালুর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেটা সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে জানাবেন।
তথ্য বলছে, গত ৫ বছরে মাটি ও বালুবাহী অবৈধ যানবাহনের চাপায় ১০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। যার অধিকাংশ রয়েছে শিশু। এছাড়া দূর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকেই। এদের মধ্যে আপাতত পাওয়া কয়েকজন নিহতের পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন, ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি শার্শার পাচভুলোট গ্রামের আবু বক্কর ছিদ্দিকের ছেলে মিজানুর রহমান নিহত হয়। গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর শার্শার উলাশী গ্রামের মনির ছেলে আব্দুর রহমান মাটির ট্রলি চাপায় নিহত হয়। ১৯ আগস্ট শার্শার উত্তর বুরুজবাগান গ্রামের মোকসেদ আলীর ছেলে খোরশেদ আলী ইঞ্জিন চালিত অবৈধ নসিমন চাপায় নিহত হয়। ২০২১ সালের ২২ মে শার্শার সেতাই গ্রামে মাটি বোঝায় ট্রাক্টরের চাপায় হাসান আলীর ছেলে বিপ্লব হোসেন নামের এক যুবক ২০২১,সালের ১৪ ডিসেম্বর শার্শার কন্যাদহ গ্রামের কোরবান আলীর ৪ বছরের শিশু সন্তান তামিম ইকবাল বালুবোঝাই ট্রাকের চাপায় নিহত হয়। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী শার্শার রামপুর গ্রামের শরিফুল ইসলামের শিশু সন্তান মাটিবাহী ট্রাকটরের ঢাক্কায় নিহত হয়। ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর শার্শার বসতপুর গ্রামের জ্যোতিস দাসের ৭ বছরের শিশু সন্তান সোহাগ দাস মাটিবাহী ট্রাকের চাপায় নিহত হয়। এসময় এলাকার ক্ষুব্ধ জনতা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।