আতঙ্ক কাটছে না সীমান্তে

ডেস্ক রিপোট:মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কয়েকদিন ধরে চলছিল রক্তক্ষয়ী গোলাগুলি। এতে সীমান্ত পেরিয়ে আসা গোলায় প্রাণ গেছে বাংলাদেশের নাগরিকের, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে। প্রাণভয়ে অনেকেই চলে যান বসতবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। গতকাল বুধবার থেকে সীমান্ত লাগোয়া রাখাইন রাজ্য থেকে গুলির শব্দ না আসায় আপাতত স্বস্তি ফিরেছে এপারের বাসিন্দাদের মধ্যে। অবশ্য ওপারের যুদ্ধ না থামায় পুরোপুরি আতঙ্ক কাটেনি সীমান্তবাসীর। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, আপাতত সীমান্তের পরিস্থিতি ভালো হলেও মিয়ানমারে কখন কী হয়, তা বোঝা মুশকিল। যে কোনো সময়েই পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।

এদিকে গতকালও প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী ও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৬৪ সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরে লড়াই থামলেও দেশটির ভেতরে তা অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী জানায়, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মিনবিয়ায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর শেষ দুটি ব্যাটালিয়নের ঘাঁটি মঙ্গলবার দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। প্রায় এক মাস অবিরাম আক্রমণ চালানোর পর তারা মঙ্গলবার মিনবিয়া শহরের বাইরে জান্তা সরকারের পদাতিক বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়নের (লাইট ইনফেনট্রি ব্যাটালিয়ন ৩৭৯ ও লাইট ইনফেনট্রি ব্যাটালিয়ন ৫৪১) সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

এক মাস ধরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) তুমুল যুদ্ধ চলছে। এর রেশ পড়ছে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশেও। গত সোমবার ওপার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে প্রাণ গেছে বাংলাদেশি এক নারীসহ দুজনের। মিয়ানমারের যুদ্ধে ওপার থেকে আসা গুলিতে শিশুসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। প্রতিনিয়তই সেখান থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে। এতে চরম আতঙ্ক ছড়ায় সীমান্তবাসীর মধ্যে।

গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। সেখানে তিনি বলেছেন, সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, অবৈধভাবে আর একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সীমান্তে উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকারে প্রস্তুত রয়েছে।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, দুই দিনের তুলনায় আজ (গতকাল) গোলাগুলির পরিমাণ একটু কম। এর আগে গোলাবারুদ, মর্টার শেল আমাদের দেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে। এজন্য সরকারের সব পর্যায় কাজ করছে।

এটি সম্পূর্ণ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং সংঘাত মন্তব্য করে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘এটার কারণে আমরা প্রতিবাদলিপিও দিয়েছি। এটা বন্ধ করতে বলেছি, যাতে কোনো ধরনের ফায়ার আমাদের বর্ডারের ভেতরে না আসে। সে কারণে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কঠোর বার্তা দিয়েছে।’

গতকাল দুপুরে রাজধানীর বনানীতে সেতু ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘আরাকান আর্মিদের সঙ্গে সংঘর্ষ তাদের দেশের সমস্যা। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তারা কী করবে, এটা তাদের ব্যাপার। তাদের সমস্যার জন্য আমাদের এখানে যেন কোনো শঙ্কা বা উদ্বেগ না হয়, সে বিষয়ে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের সঙ্গে কথা বলব। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে গেছেন। চীনের সঙ্গেও আমরা আলাপ-আলোচনা করছি।’

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বাসিন্দারা ফিরছেন: স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া লোকজন গতকাল বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। তবে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িঘরে আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দারা এখনো পরিস্থিতি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সকাল (গতকাল) থেকে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা অনেকটা স্বাভাবিক আছে। মাঝেমধ্যে গুলির শব্দ পেলেও টানা গোলাগুলির তেমন কোনো শব্দ শোনা যায়নি। গত কয়েকদিন সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে ছিলেন এলাকাবাসী। তাই জেলা প্রশাসনের নির্দেশে আমরা সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দাদের নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলি। তবে আজ (গতকাল) পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় লোকজন বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।

এদিকে গতকাল সীমান্ত এলাকার বাজারেও মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে; খুলেছে দোকানপাট। মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকির খুব কাছে বাংলাদেশের ঘুমধুম ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া। এই গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত রোববার থেকে তারা জীবনের ভয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ফেলে অনত্র চলে যান। গুলির শব্দ কমায় এখন বাড়ি ফিরেছেন।

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, মূলত মঙ্গলবার রাত থেকে গুলির শব্দ কমেছে। তবে এলাকার মানুষজন এখনো আতঙ্কে আছে। কারণ যে কোনো সময়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।

মিয়ানমারের আরও ৬৪ জন আশ্রয় নিয়েছে: বিজিবি সদর দপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিয়ানমার বিজিপি, সেনা, ইমিগ্রেশন ও আরও ৬৪ সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে বিজিবির হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে গত কয়েকদিনে ৩২৮ জন বিজিবির কাছে আশ্রয় পেয়েছে।

এদিকে গতকাল বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের এখানে আশ্রয় নিয়েছে, মিয়ানমার তাদের নিয়ে যেতে প্রস্তুত। যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যেতে বলেছি। আমরা আশাবাদী, শিগগিরই এর একটি সমাধান হবে।’

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকে যারা আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের আমরা বাসস্থান, খাবার ও নিরাপত্তা দিচ্ছি। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত আটজনের মধ্যে চারজন কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও চারজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আশ্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন নারী ও দুটি শিশু আছে জানিয়ে বিজিবিপ্রধান বলেন, ‘তাদের নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করার দায়িত্ব, মানবিক কারণে এবং আন্তর্জাতিক রীতি ও সুসম্পর্ক রাখার কারণে আমরা করছি।

সীমান্তের পর এবার আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে: স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র উদ্ধৃত করে কালবেলার কক্সবাজার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চলমান সংঘর্ষে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বিজিপির সঙ্গে মিশে গিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার উখিয়ার পালংখালীর বটতলী সীমান্ত দিয়ে ৩৭ জন বিজিপি সদস্যদের সঙ্গে আরসার দুই সদস্য ফজলুল কবির আবু আনাস ও হামিদ শোয়াইব ছিল। এ ছাড়া থাইখালীতে স্থানীয়দের হাতে অস্ত্রসহ ২৪ মিয়ানমারের নাগরিক আটক হয়। এরপর থেকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ক্যাম্পে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা আরএসও এবং আরসার নামে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে নীব হোসেন গ্রুপ নামে আর একটি গ্রুপ বিজিপির সঙ্গে কাজ করছে। এ অবস্থায় চলমান সংঘাতে যদি এসব রোহিঙ্গা অস্ত্রসহ ক্যাম্পে প্রবেশ করে, তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি হতে পারে।

জানতে চাইলে ১৪ এপিবিএন এর অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ক্যাম্পে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা সচেষ্ট রয়েছি। তারপরও ফাঁক-ফোকর দিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক সদস্য সতর্ক রয়েছে। কোনো অবস্থায় আর কোনো রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু ক্যাম্প এলাকা নয়, দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছে পুলিশ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)