বাংলাদেশেই এই গ্রামে ২০০ বছরেও যায়নি পুলিশ
ডেস্ক নিউজ:
নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৯ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা শান্ত হুলহুলিয়া গ্রামটি চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত। ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলন বিলবেষ্টিত এ গ্রামের আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। হুলহুলিয়া গ্রামের প্রবেশ পথের পাঁচ গজ পার হলেই হাতের বাম পাশে দেখা যাবে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ।
গ্রামের মানুষকে চমৎকার ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধেছে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ।’ এই পরিষদ হুলহুলিয়াকে আধুনিক গ্রাম হিসেবে গড়তে কাজ করছে। অনেকে মনে করেন, এ গ্রামটি রাষ্ট্রের মধ্যে ছোট আরেকটি রাষ্ট্র। কবি বন্দে আলী মিয়া তার কবিতায় যে আদর্শ গ্রামের ছবি এঁকেছিলেন, ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।’ সেরকমই একটি গ্রাম হুলহুলিয়া।
এ গ্রামে নেই চুরি-ডাকাতি, ঝগড়া-বিবাদ কিংবা রাজনৈতিক বিরোধ। গ্রামটি বেকারত্ব ও মাদকের ছোবল থেকে মুক্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ গ্রামের কেউ কখনো মামলা করতে থানায় যাননি। প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে এ গ্রামে কখনো অপরাধী ধরতে পুলিশ ঢোকেনি। শুধু পুলিশ ঢুকেছে চাকরির ভেরিফিকেশন জন্য। গ্রামটিতে শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। বাসিন্দাদের অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষায় আলোকিত। স্যানিটেশন সুবিধাও শতভাগ। এখানে বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের প্রচলন নেই।
জানা যায়, গ্রামবাসী ১৩টি পাড়া থেকে দুই বছরের জন্য এই পরিষদ ২০ জন সদস্য ও পাঁচজন উপদেষ্টা মনোনীত করেন। আর সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান। গ্রামটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কোনো পাড়ায় কারো কোনো সমস্যা হলে সেই পাড়ার মনোনীত সদস্যরা ঐ সমস্যার সমাধান করবেন। সেখানে সমাধান না হলে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে আবেদন করতে হবে। উন্নয়ন পরিষদে সমস্যার সমাধান না হলে ৩০ দিনের মধ্যে দেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে হবে। তবে এই গ্রামটির কোনো সদস্যকে এখন পর্যন্ত দেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে হয়নি।
হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশ বলেন, দুইশ’ বছর আগ থেকে সামাজিকভাবে এই গ্রামের সকল সমস্যার সমাধান চলে আসছে। তবে ১৯৪০ সালে মরহুম জালাল উদ্দিন মৃধাকে প্রথম চেয়ারম্যান করে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। আর এই সময় থেকে তাদের গঠনতন্ত্র দিয়ে চলছে এই গ্রাম।
তিনি বলেন, শতভাগ শিক্ষিত গ্রামটির অধিকাংশ মানুষ উচ্চ শিক্ষিত। গ্রামটির ১শ’ জনের অধিক ডাক্তার, ২শ’ জনের অধিক ইঞ্জিনিয়ার, ১১ জন বিচারকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন। গ্রামটিতে সর্বনিম্ন লেখাপড়া জানা মানুষ কমপক্ষে এসএসসি পাস।
আল তৌফিক পরশ জানান, গ্রামটির কারো লেখাপড়ার খরচ বহন করার সামর্থ্য না থাকলে তাদের পরিষদ থেকে তা বহন করা হয়।
হুহলুলিয়া গ্রামের মেয়ে ও গৃহবধূ বিনতীয়া বেগম বলেন, এই গ্রামের জন্মগ্রহণ করে নিজেকে ধন্য মনে করি। বিভিন্ন অফিস আদালতে গেলে আমাদের গ্রামের মানুষজনকে পাওয়া যায় এবং আমরা শান্তিতে সবাই বসবাস করি। এই গ্রামে শিক্ষিতের হার বেশি।
এ বিষয়ে হুহলুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক আব্দুর রশিদ বলেন, এই গ্রামে চিকিৎসা সেবার জন্য সব ব্যবস্থা আছে। শিক্ষা থেকে শুরু করে সবকিছুই মেলে গ্রাম উন্নয়ন পরিষদে।
চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল আলম ভোলা জানান, হুলহুলিয়া একটি আদর্শ গ্রাম। এই গ্রামে হামলা মামলা হয় না। যদি ছোটখাটো কিছু হয় তারা নিজেরাই হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ মাধ্যমে সমাধান করে থাকেন। এই গ্রামের কৃতি সন্তানেরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কর্মরত আছেন।
এ বিষয়ে সিংড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদা খাতুন বলেন, হুলহুলিয়া একটি আদর্শ মডেল গ্রাম। যে গ্রামে কেও থানায় মামলা করে না। কোনো সমস্যা হলে তারা হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে সমাধান করে থাকেন।