তালায় ড্রাগন চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
ফারুক সাগর: সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ড্রাগন চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়েছে। উপজেলার ড্রাগন চাষের প্রথম উদ্যোক্তা কলেজ শিক্ষক তৌহিদুজ্জামান। তিনি ৭ বিঘা জমিতে মৌসুমে ড্রাগন চাষে সফলতার পর এবার শুরু করেছেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। শিক্ষক তৌহিদুজ্জামান তালা উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামের মৃত:স্কুল শিক্ষক ওমর আলীর ছেলে ও খুলনা সুন্দরবন সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। প্রায় বছর তিনেক আগে পাশ্ববর্তী মাগুরা ইউনিয়নের ফলেয়া গ্রামের মাগুরা-পাটকেলঘাটা সড়কের পাশে তার বাগানটি অবস্থিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে,তিনি সফলতা পাওয়া উদ্বুদ্ধ হয়ে এই চাষাবাদে প্রায় ১বিঘা জমিতে ভারশা গ্রামের রায়হান আওরঙ্গী;মাগুরা ডাঙার আব্দুল্লাহ আল মাসুম ৫ বিঘা জমি ও বাগমারা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য শাহীন কাগুচী ৪ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষাবাদ করেছে।
তৌহিদুজ্জামানের ড্রাগন বাগানে গিয়ে দেখা গেছে,৭ বিঘার জমিতে প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতায় ১৪শ’ কংক্রিটের খুঁটি বসানো রয়েছে। যার প্রতিটির দুরত্ব দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৭ ফুট ও সাড়ে ৬ ফুট প্রস্থে। প্রতিটি খুঁটি পেঁচিয়ে বাগানাকৃতিতে ঝুলে রয়েছে সুস্থ্য-সামর্থবান ৪টি করে ড্রাগন গাছ। চারিদিকে যেন সবুজের সমারোহ। শীত মৌসুমে গাছে ফুল-ফল নেই। তবে শীতকালে ড্রাগন গাছ থেকে আগাম ফুল-ফল আনতে বাগানে নতুন করে আলাদা অন্তত ২শ’ বাঁশের খুঁটি পুতে তার টানিয়ে উচ্চ ক্ষতাসম্পন্ন ৮শ’ বাল্ব স্থাপন করেছেন। উচ্চ ক্ষতাসম্পন্ন এই বাল্ব ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সরাসরি চীন থেকে আমদানি করেছেন তিনি।
বাণিজ্যিকভাব ড্রাগন আবাদের উদ্যোক্তা অধ্যাপক তৌহিদুজ্জামান বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রথম থেকেই তিনি কৃষি অনুরাগী। তিনি খুলনায় থাকলেও প্রায়শই এলাকার বেকার শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে চাকুরীর বিকল্প হিসেবে কিভাবে লাভজনক কৃষিতে সমন্বয় করা যায় তা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ইউটিউব দেখে ড্রাগনের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে তার। প্রথমত ২০২০ সালের দিকে তিনি নিজ এলাকায় ৭ বিঘা জমি বাৎসরিক ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লীজ নিয়ে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেন। সফলতা পাওয়ায় পাশেই আরো ৫ বিঘা জমিতে ইজারা নিয়ে ড্রাগনের আবাদ সম্প্রসারণ করছেন। ড্রাগনের আবাদে সফলতা পাওয়ার পর অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেন। এখন তাকে দেখে এলাকার অনেকেই ড্রাগনের আবাদ শুরু করেছেন এবং সাফল্যও পাচ্ছেন।
প্রথম বছর সব মিলিয়ে ২৩ লক্ষ টাকা খরচ হয় তার। এরপর ফল আসার দু’বছরেই তিনি লগ্নিকৃত সমুদয় টাকা উত্তোলনের পর লাভের মুখ দেখেন। বর্তমানে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সফল। এদিকে সফলতার পর এবার তিনি প্রকল্প সম্প্রসারণে অনতিদূরে আরো ৫বিঘা জমি ইতোমধ্যে আবাদ উপযোগী (জমি প্রস্তুত) করেছেন। সেখানকার জন্য কাটিং প্রক্রিয়াকরণও সম্পন্নের পথে। এখানেই শেষ নয়, গ্রীষ্মকালীণ ড্রাগন ফলটি সমভাবে শীতকালেও উৎপাদনর জন্য তিনি বিশেষ বৈদ্যুতিক আলোর আশ্রয় নিয়েছেন। ড্রাগন মূলত গ্রীষ্মকালীন ফল। শীতের মৌসুমে ড্রাগন গাছে ফুল-ফল আসেনা। গ্রীষ্মকালীণ ফলটি সমানভাবে শীতকালেও ফলাতে তিনি ইতোমধ্যে প্রকল্পে স্থাপন করেছেন,চায়না থেকে আমদানিকৃত বিশেষ বৈদ্যুতিক বাল্ব। বৈজ্ঞনিক এ পদ্ধতিতে শীত মৌসুমে ড্রাগন আবাদে সফলতা পেলে তাকে দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হবেন এমনটাই মনে করছেন তার পাশাপাশি কৃষি অধিদপ্তরও।
সর্বশেষ ড্রাগন চাষের আধুনিক পদ্ধতি এবং সারা বছর ড্রাগন চাষের বৈজ্ঞাণিক পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হন তিনি। তাই গ্রীষ্মকালীণ ফলটি সমানভাবে শীতকালেও ফলাতে ইতোমধ্যে বাগানে স্থাপন করেছেন, চায়না থেকে আমদানিকৃত বিশেষ বৈদ্যুতিক বাল্ব। আর এই বাল্ব সন্ধ্যা ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা ও রাত ৪টা সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত জ্বালিয়ে রাখেন। বৈজ্ঞনিক এ পদ্ধতিতে শীত মৌসুমে ড্রাগন ফল পাওয়া যাবে, আর এ পদ্ধতি প্রয়োগে তিনি সফলতা পেলে তাকে দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হবেন এমনটাই আশা তার। এসময় তিনি শিক্ষিত বেকারদের উদ্দেশ্য বলেন, পড়া-লেখা শেষ করে চাকরির আশায় না ঘুরে তারা যদি নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে ড্রাগন ফল চাষ করে তাহলে নিজেদের বেকারত্ব দুর হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরকেও নিজ বাগানে চাকরি দিতে পারবে।
সরুলিয়া ইউনিয়নের ভারশা গ্রামের রায়হান আওরঙ্গী বলেন,বর্তমানে বাজারে ড্রাগন ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে এক শ্রেণীর অসাধু ড্রাগন চাষী ফল আকার ও ওজন বৃদ্ধির লক্ষ্যে টনিক ব্যবহার করছে। প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটিয়ে ৩০০-৪৫০ গ্রামের ফল পাওয়া যায়। ড্রাগন ফলটি সম্পূর্ণভাবে পিংক রংয়ের হয়ে থাকে। সেই সাথে খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হয়। অন্যদিকে টনিক ব্যবহারে ফলের ওজন ৬০০-৯০০ গ্রাম হয়। এক্ষেত্রে ফলটি হালকা সবুজ হালকা পিংক রংয়ের হয়ে থাকে। এবং ফলটির খোসার পুরুত বেশি হয়। আমি প্রাকৃতিক পরাগায়নের মাধ্যমে ফল উৎপাদন করি। যার কারণে বাজারে ভাল দাম পাই। সেই ধারাবাহিকতায় একবার বাগান তৈরি করলে একটানা ২৮-৩০ বছর ফল নেওয়া যায় বলে জানান তিনি।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ড্রাগন মূলত গ্রীষ্মকালীন ফল। শীতের মৌসুমে ড্রাগন গাছে ফুল-ফল আসে না। ড্রাগন গাছে ফুল আসতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমানে দিনের আলোর প্রয়োজন। গ্রীষ্মে দিন বড় থাকায় গাছটি মূলত পরিপূর্ণ আলো পেলেও শীতকালে দিন ছোট হওয়ায় পর্যাপ্ত আলো পায় না।সন্ধ্যায় সূর্যের আলো চলে গেলে অন্ধকারে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে গাছের বৃদ্ধি ঝিমিয়ে পডে। এতে বিলম্বিত হয় ফুল ফোটা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক চার বছর চেষ্টার পর দিনের আলোর বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রিক বাল্ব ব্যবহার করে শীতকালে গ্রীষ্মকালীন ফলটি ফলাতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ এই বাল্বের আলো সূর্যের আলোর মতোই। তাই শীতকালে ড্রাগন গাছ থেকে আগাম ফুল-ফল পেতে সূর্যের আলোর বিকল্প হিসাবে ড্রাগন বাগানে ব্যবহার হচ্ছে বিশেষ বৈদ্যুতিক বাল্ব।
তালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাজিরা খাতুন জানান, ড্রাগন একটি পুষ্টিকর ফল। এই ফলে রয়েছে অধিক পরিমাণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা,যা মানবদেহের জন্য অনেক উপকারী। বিশেষ করে ডায়বেডিস রোগীদের জন্য কার্যকারী একটি ফল। তালার প্রথম ড্রাগন চাষী (উদ্যোক্তা) অধ্যাপক তৌহিদুজ্জামান তার বাগানে ইলেকট্রিক বাল্ব ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শীতকালীন ড্রাগন চাষাবাদ করছেন। ইলেকট্রিক বাল্ব ব্যবহার করে সারাবছর ড্রাগন চাষ করা যাবে বলে জানান তিনি।