রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা, ৬ বছরে পালিয়েছে তিন লাখ
ডেস্ক নিউজ:
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করার জন্য প্রায় ১৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩টি আশ্রয়শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন সেই কাঁটাতারের বেড়া কেটে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য, প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা, স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই, বাড়তি আয়রোজগার ও কাজের সন্ধানে আশ্রয়শিবির ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ আসে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। দীর্ঘ ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, ছয় বছরে আশ্রয়শিবির থেকে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন পাহাড়ের বসতিতে অবস্থান করছে। বাকি দেড় লাখ টেকনাফ, উখিয়া, ঈদগাঁও, রামু, চকরিয়া উপজেলাসহ তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় বসতি গড়েছে। গত ছয় বছরে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, যশোর, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, বরিশালসহ ১৭টি জেলা থেকে ৬৮ হাজার ৫৭২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠিয়েছে।
আশ্রয়শিবির ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালানোর ঘটনা দেশের জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ মন্তব্য করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি ও উচ্ছেদ করে আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, কতজন রোহিঙ্গা পালিয়েছে, তা শনাক্ত করতে গণনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। প্রথমে কয়েকটি আশ্রয়শিবিরের একাধিক ব্লকে রোহিঙ্গাদের তালিকা ধরে গণনার কাজ করা হবে। সেখানে অনুপস্থিতি পাওয়া গেলে অন্যান্য আশ্রয়শিবিরেও গণনা করা হবে। যদিও কাজটি করা কঠিন।
রোহিঙ্গাদের পালানোর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন। এরপরও সচ্ছল জীবনের আশায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া কেটে পালিয়ে যাচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন তারা। এরপরও কাজ না হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কাজের সন্ধানে আশ্রয়শিবির ত্যাগ
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের মধ্যভাগে উখিয়ার কুতুপালং বাজার। গত শুক্রবার সকাল ৯টায় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল শতাধিক রোহিঙ্গা। কিছুক্ষণ পর টেকনাফ থেকে একটি বাস এসে থামে। ১০-১৫ জন রোহিঙ্গা বাসে উঠল। বাস ছুটল কক্সবাজারের দিকে। দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, লম্বাশিয়া ও মধুরছড়া ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, কাজের জন্য কয়েকশ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ছেড়ে টেকনাফ-কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদ বলেন, কাজের সন্ধানে এই আশ্রয়শিবির থেকে অন্তত তিন হাজার রোহিঙ্গা পালিয়েছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান করছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ-সংলগ্ন সড়কে অস্থায়ী তল্লাশিচৌকি বসিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামগামী কয়েকটি যানবাহনে তল্লাশি করে পুলিশ। এ সময় ৪০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার শহরের লিংক রোডে একাধিক বাস থেকে ৫৮ জনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ১৯ সেপ্টেম্বর ২৬০ জনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত ৬ দিনে ৪৭২ জন রোহিঙ্গা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। আগের দুই মাসে আটক হয় আরো ৯২০ জন। গত ৬ বছরে সারা দেশ থেকে আটক করে ৬৮ হাজার ৫৭২ জন রোহিঙ্গাকে আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়।
উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, আটক রোহিঙ্গাদের ৯০ শতাংশই কাজের সন্ধানে ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ১০টি তল্লাশিচৌকি আছে। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া কেটে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
শুধু কক্সবাজার পৌরসভার বিভিন্ন পাহাড়ে অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা বসতি গেড়েছে বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ঐ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত দেড় হাজার নানা কৌশলে ভোটার হয়েছে। ১ হাজার ২০০ জন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছে। গত বুধবারও ঝালকাঠিতে পাসপোর্ট করতে গিয়ে একজন রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে। কক্সবাজারের শ্রমবাজার এখন রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। আশ্রয়শিবিরে গণনা করলে কতজন রোহিঙ্গা নেই, সেই তথ্য পাওয়া যাবে।
পৌরসভার ভেতরে সরকারি পাহাড় দখল করে লাখো রোহিঙ্গা বসতি করেছেন জানিয়ে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, কৌশলে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার অভিযোগ তার কাছেও এসেছে। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখছেন। রোহিঙ্গার তালিকা করতে পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে কমিটি করা হচ্ছে। তালিকার পর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হবে।
কাঁটাতারের বেড়া কেটে ২০০ গোপন পথ
আশ্রয়শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া কেটে ২০০টির বেশি গোপন পথ তৈরি করা হয়েছে। ভোর ও সন্ধ্যায় এসব পথ দিয়ে রোহিঙ্গারা দল বেঁধে বের হচ্ছে। কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের আমগাছতলা এলাকায় দেখা গেছে, কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে গ্রিলের গেট লাগানো। গেট দিয়ে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা বের হচ্ছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে কক্সবাজারগামী বাসে উঠছিল ফয়সাল নামের এক রোহিঙ্গা যুবক। কারণ জানতে চাইলে সে বলেন, কক্সবাজার শহরের খাজামঞ্জিল পাহাড়ে তার দুই ভাই থাকেন। আয়-রোজগারের জন্য তিনিও সেখানে যাচ্ছেন।
আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিক বলেন, তল্লাশিচৌকির কারণে রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবিরের বাইরে যেতে পারে না। তাই কাঁটাতারের বেড়া কেটে বাইরে যাচ্ছে। প্রতিদিন ভোর ও সন্ধ্যায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ কাজের সন্ধানে বাইরে যায়। কাজ শেষে কিছু রোহিঙ্গা রাতের বেলায় আশ্রয়শিবিরে ফিরে আসে।
৮ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর বলেন, প্রত্যাবাসনে দেরি হওয়ায় হতাশ রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবির থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে। তল্লাশিচৌকিতে কড়াকড়ি থাকায় কাঁটাতারের বেড়া কাটছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক গোপন পথ চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুত সংস্কার করতে সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানানো হয়েছে।
উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ায় জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক এবং কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে ১৫টির বেশি চেকপোস্ট আছে। সেখানে নজরদারি আরো বাড়ানো দরকার।