ইতালি যাওয়ার পথে শরীয়তপুরের ৪ যুবক নিখোঁজ, পরিবারে শোকের মাতম
নিউজ ডেস্কঃ
দারিদ্র্যতা দূর করতে গত বছরের অক্টোবরে লিবিয়া যান শওকত ফকির। সেখান থেকে সমুদ্রপথে রওনা দেন ইতালির উদ্দেশ্যে। এরপর চার মাস ধরে তার কোনো সন্ধান পাচ্ছে না পরিবার। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, এ খবরও জানেন না কেউ। ছেলের খোঁজ পাবেন, এমন আশায় মা সুফিয়া বেগম চোখের পানি ফেলে যাচ্ছেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার শরীয়তপুর আদালতে বাচ্চু ব্যাপারী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এদিকে, মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা করার পরামর্শ পুলিশ সুপারের।
নিখোঁজ শওকত ফকির শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া ইউনিয়নের দড়িহাওলা গ্রামের রুপচাঁন ফকির ও সুফিয়া বেগম দম্পত্তির ছেলে। চার ভাই এক বোনের মধ্যে বড় শওকত।
জানা যায়, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন শরীয়তপুরের চার যুবক। শরীয়তপুরের ডামুড্ডা উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের গংগেসকাঠি গ্রামের দালাল বাচ্চু ব্যাপারী খপ্পরে পড়ে ওই চার যুবক প্রথমে লিবিয়া যান। পরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন তারা। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার শরীয়তপুর আদালতে বাচ্চু ব্যাপারী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
নিখোঁজ শওকত ফকিরের মা সুফিয়া বেগম কান্নাজরিত কন্ঠে বলেন, ইসলামপুর ইউনিয়নের দালাল বাচ্চু ব্যাপারী আমার ছেলেকে ইতালি নেবে বলে প্রথমে সাত লাখ টাকা নেন। পরে ইতালি না নিয়ে আমার ছেলেকে লিবিয়া পাঠান। লিবিয়া নিয়ে মাফিয়াদের হাতে তুলে দেন বাচ্চু। ছেলেকে মারধর করে আরো চার লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। আমি চোখে মুখে কিছু না দেখে বিভিন্ন এনজিও ও গয়না বিক্রি করে আরো চার লাখ টাকা দেই। মোট ১১ লাখ টাকা দিয়েছি বাচ্চুকে।
পরে গত ২১ রমজানে বাচ্চু মোবাইল ফোনে বলেন, ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে শওকতকে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠাবে। এরপর থেকে বাচ্চুর মোবাইল বন্ধ। তিনি আর যোগাযোগ করেনি আমাদের সঙ্গে। আর আমার ছেলেও নিখোঁজ। ছেলের কোনো খোঁজ নেই। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই। আর টাকা ফেরত চাই। তাই শরীয়তপুর আদালতে বাচ্চু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি।
শুধু শওকত ফকিরই নন, চার মাস ধরে নিখোঁজ আছেন ডামুড্যা উপজেলার ধানকাঠি ইউনিয়নের মডেরকান্দি গ্রামে আলী আকবর, ইসলামপুর ইউনিয়নের বিন্দাইকাঠি গ্রামের কামাল ব্যাপারী ও ফয়সাল মাদবর। এই যুবকদের ১১ লাখ টাকায় ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা দালাল বাচ্চু ব্যাপারীর। কিন্তু তা না করে ৭ লাখ টাকা করে নিয়ে লিবিয়া নেন তাদের। পরে লিবিয়া নিয়ে মাফিয়ার ভয় দেখিয়ে চার লাখ টাকা করে পরিবারের কাছে আদায় করেন বাচ্চু।
নিখোঁজ আলী আকবরের মা মাসুদা বেগম জানান, দারিদ্র্যের কারণে তার ছেলে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজ নেন। এরপর হঠাৎ ইতালি যাওয়ার বায়না ধরেন। এনজিও থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে তাকে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন মা। তাদের পাশের গ্রামের বাচ্চু ব্যাপারীর সঙ্গে ১১ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। দুই দফায় বাচ্চুর বাবা মজিবর ব্যাপারীর কাছে টাকা দেন। লিবিয়া নিয়ে প্রথমে চার মাস আটকে রাখেন। এরপর আবার টাকা পাঠানোর পর ‘গেম দিতে’ (ট্রলারে করে সাগর পাড়ি দিতে) রাজি হন। ছেলে ১২ এপ্রিল রাতে ফোন দিয়ে জানান, পরদিন তাদের নিয়ে ট্রলার ইতালির উদ্দেশে রওনা দেবে। এরপর আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
ভুক্তভোগী পরিবার নিখোঁজ চারজনের মধ্যে কারও রয়েছে সন্তান, কারও বা স্বামী। এ অবস্থায় চরম হতাশায় দিন কাটছে পরিবারগুলোর। তারা বলেন, বাচ্চুর লোকজন এলাকায় প্রচার করেছে, ট্রলারডুবিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আমরা জানি না ছেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে। আমরা এখন দিশেহারা।
মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান (মাসুদ) বলেন, আমাদের জেলার মানুষ বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তারা ধার, সুদ ও ঋণ করে দালাল চক্রর হাতে টাকা দেন সন্তানকে ইতালি যাওয়ার জন্য। পরে দেখা যায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় দালালরা তাদের ভূমধ্যসাগর পাড়ি ইতালিতে পাঠাচ্ছে। কিন্তু সাগর পারি দেওয়ার সময় অনেক যুবকের মৃত্যু হয়। তাছাড়া দালালরা তাদের মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয়। পরে মাফিয়ারা মুক্তিপণ দাবি করে। আমি বলবো, যারা সন্তানদের বিদেশে পাঠাবেন তারা সরকারিভাবে পাঠান। এতে টাকা ও জীবনের নিরাপত্তা থাকবে।
এদিকে, ঘটনার পর থেকে লাপাত্তা অভিযুক্ত বাচ্চু বেপারী। বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি কাউকে।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম বলেন, অনেকেই বৈধ পথ পরিহার করে অবৈধ পথে বিদেশ যেতে চেষ্টা করছে। অবৈধ পথে যাওয়ার জন্য তারা দালানের মাধ্যমে টাকা দিচ্ছে। সেই টাকা মার যাচ্ছে, অথবা অপহরণের স্বীকার হচ্ছে। তাছাড়া সমুদ্র পথে যাচ্ছে এবং বিদেশে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না। তারা দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে।
তিনি আরো বলেন, এতে যেটা হচ্ছে, যে যাচ্ছে সেই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু তাই না। তার পরিবারসহ সকলেই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আমি বলবো, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা করুন। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি মানবপাচার রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।