সাতক্ষীর বিআরটিএ অফিস যেন ঘুষের আখড়া

ইব্রাহিম খলিল :

ঘুষের আখড়ায় পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সাতক্ষীরা জেলা অফিস। ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না সাতক্ষীরা বিআরটিএ অফিসে, যে কোন কাজ ঘুষ দিলে সঙ্গে সঙ্গে মিলবে । আর না দিলে শুরু হবে হয়রানি। ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোটরযান রেজিষ্ট্রেশন, ফিটনেস, শ্রেণি পরিবর্তন, রুট পারমিট, সরকারি প্রতিবেদনসহ সর্বক্ষেত্রে দিতে হয় রেশিও অনুসারে ঘুষ। ঘুষের টাকা ঠিকঠাকভাবে না পেলে ফাইলে ভুল আছে জানিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিআরটিএ অফিসে সাধারনের কাছ থেকে কোন ফাইল জমা নেওয়া হয় না। জমা নেওয়া হয় শো রুম প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। শো রুম প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ফাইল জমা নিলে সহজেই ঘুষের টাকা নেওয়া যায়। প্রতিটা শোরুম প্রতিনিধি প্রতিদিন কয়টা কাজ করে সন্ধ্যার পর হিসাব করে ঘুষের টাকা মাষ্টার রোলে কর্মরত শরিফুর রহমান শরিফের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হয়। শরিফ এবার সমুদয় টাকা কর্মকর্তাদের রেশিও অনুযায়ি বন্টন করে থাকে। সব কিছু ছায়ার মত দেখভাল করেন সহকারি পরিচালক (ইঞ্জি:) কে এম মাহবুব কবির ও মটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) রামকৃষ্ণ পোদ্দার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শোরুম প্রতিনিধি জানান, গত ৭/৮ মাসের ব্যবধানে সাতক্ষীরা বিআরটিএ অফিসে ঘুষের পরিমান দিগুন হয়েছে। আগের এডি স্যার থাকতে নতুন গাড়ি রেজিষ্ট্রেশন করতে ঘুষ দিতে হত ১০০০টাকা বর্তমানে দিতে হয় ২০০০ টাকা। মালিকানা পরিবর্তন আগে ছিল ১৫০০ টাকা এখন দিতে হয় ২০০০টাকা। ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার ফি আগে ছিল ২২০০ টাকা এখন দিতে হয় ৩২০০টাকা। ফিঙ্গার খরচ আগে ছিল ২০০ টাকা এখন দিতে হয় ৬০০ টাকা। পুরাতন গাড়ি সে সব গাড়ি লাইসেন্স করেননি তাদেরকে বছর অনুযায়ি ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। রুট পারমিটের জন্য দিতে হয় ২০০০ টাকা। ফিটনেস বাবদ ঘুষ দিতে হয় ২৫০০ টাকা। এছাড়া গাড়ির স্মার্ট ড্রাইভিং কার্ড নিতে গেলে দিতে হয় টাকা।

তারা আরও জানায় বর্তমান সহকারি পরিচালক (ইঞ্জি:) কে এম মাহবুব কবির যোগদানের পর সব অফিস স্টাফ ও শোরুম প্রতিনিধিদের ডেকে ঘুষের রেট নির্ধারন করে দেয়। শো রুম প্রতিনিধিরা আপত্তি জানালে বিআরটিএ কতৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেয় উক্ত রেট অনুযায়ি ঘুষের টাকা দিতে হবে। শোরুম প্রতিনিধিরা কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর তাদেরকে আবার ডেকে নভেম্বর ও ডিসেম্বর পুরাতর রেট অনুযায়ি কাজ হবে জানুয়ারি ২০২৩ সাল থেকে নতুন ঘুষের রেট অনুযায়ি কাজ হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত শোরুম প্রতিনিধিরা ঘুষের নতুন রেট অনুযায়ি কাজ করছে।

ভুক্তভোগি শোরুম প্রতিনিধিরা আরও জানান, মাষ্টার রোলে কর্মরত শরিফ যেন অফিসের প্রধান বস। সে প্রত্যেকের সাথে খারাপ আচারন করে। সে অফিসের নির্ধারিত ঘুষ ছাড়া নিজস্ব কারিশমায় অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করে। যারা ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স পাননি তাদেরকে বলে আপনাদের বাড়তি আরও দুই থেকে তিন হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হবে। তা না হলে কার্ড পাবেন না। এভাবে সে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। ১০/১২ বছর বিআরটিএ অফিসে মাস্টার রোলে কাজ করে সে আজ অঢেল সম্পত্তির মালিক।

খোজ নিয়ে আরও জানা যায়, নতুন গাড়ী রেজিষ্ট্রেশন করতে সাতক্ষীরার শো-রুম থেকে বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টাল (বিএসপি) করা হলে ফাইল প্রতি দিতে হয় পাঁচশত টাকা এবং বাহিরের ফাইল হলে দিতে হয় আরও এক হাজার টাকা। একই সাথে সকল প্রকার স্মার্ট কার্ডে আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার সময় একশ টাকা এবং কার্ড গ্রহনের সময়ে দিতে হয় আরও একশ টাকা।

খোজ নিয়ে আরও জানা যায়, মোটরযানের শ্রেণী পরিবর্তন বা সংযোজন/ধরণ পরিবর্তন/অন্তর্ভুক্তি/পিএসভি/করতে হলে প্রতি ফাইলে দিতে হয় কমপক্ষে এক হাজার টাকা। টাকা না দিলে ফাইলে ভুল আছে জানিয়ে ফেরত দেওয়া হয়।

আরও জানা যায়, গ্রাহক মোটরযানের ফিটনেস ইস্যু/নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে মোটরযান পরিদর্শক সরেজমিনে মোটরযানটি দেখে এক বছরের জন্য ফিটনেস ইস্যু/নবায়ন করেন। যেসব গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় এক হাজার পাঁচশত থেকে তিন হাজার টাকা। গাড়ির রুট পারমিট নিতে হলেও দিকে হয় একই পরিমান টাকা।

আরও জানা যায়, কোন সরকারি দপ্তর থেকে গাড়ির প্রতিবেদন চাইলে নানা ভাবে গাফিলতি করা হয়। এরপর টাকা নিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবেদন।

শরিফুর রহমান শরিফের ব্যাবহৃত মোবাইল নাম্বার ০১৭১৪ ৯৬২১৩৬ একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সহকারি পরিচালক (ইঞ্জি:) কে এম মাহবুব কবিরের সাথে মুঠোফোনে কথা হয়, তিনি বলেন, সাতক্ষীরা বিআরটিও অফিসে লোকবল সংকট আছে। সে জন্য মাষ্টার রোলে কিছু লোক কাজ করে। বিআরটিএ অফিসে মোটরযান এনডোর্সমেন্ট, মোটরযানের রেজিষ্ট্রেশন, ফিটনেস সার্টিফেকেট, স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোটরযানের শ্রেণী পরিবর্তন বা সংযোজন/ ধরণ পরিবর্তন / অন্তর্ভুক্তি / পিএসভি / তথ্য সংশোধন, ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট, রুট পারমিট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ কি পরিমান ঘুষ দিতে হয়। এমন প্রশ্ন করলে তিনি কিছুটা রাগান্নিত হয়ে বলেন আমার অফিসে কাজ করতে হলে কোন ঘুষ লাগে না। সরকার শোরুম প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ফাইল জমা নিতে বলেছে সেটাই করা হয়। এটার সারকুলার আছে আপনি দেখতে পারেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কত টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন বলে মোবাইলের সংযোগ বিছিন্ন করে দেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)