ভরসার প্রতীক থেকে একজন অবহেলিত মাহমুদউল্লাহ
অনলাইন ডেস্ক:
‘একদিন সব অবহেলা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেব’। কবির সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কণ্ঠ মিলিয়ে অবহেলার কঠিন জবাব দিয়েছিলেন ২০২১ সালে শেষ টেস্ট ম্যাচে। সেদিন ‘সাইলেন্ট কিলার’ খ্যাত এই বাংলাদেশি ক্রিকেটার নিজের জাত চিনিয়েছিলেন আরও একবার। কিন্তু এখন তার জন্য ‘সময় বড় নিষ্ঠুর’ হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক সময় অটো চয়েস হিসেবে খেলতেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। কারণ দল তার ওপরে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারত। কিন্তু কালের বিবর্তণে সেই ভরসায় মরিচা পড়েছে, তৈরি করেছে ক্ষত। ক্ষত সারাতে পারেন মাহমুদউল্লাহ নিজেই। তবে তার বয়স এখন ৩৭ পেরিয়েছে। ১৪ বছর বয়সে ব্যাট হাতে নজর কাড়া মাহমুদউল্লাহ এখন হয়তো এক পা এগিয়ে দু’পা পিছিয়েই যাচ্ছেন। তবু ভক্তদের মনে তিনি এখনও ভরসার প্রতীক হয়ে আছেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার
ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী মাহমুদউল্লাহ ২০০০ সালে এসিসি অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকায় আসেন। তার আগে নিজ শহরে হাতেখড়ি হয় ক্রিকেট নামক জনপ্রিয় খেলাতে। পেশাদার ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে। সে সময়ে ঘরের মাঠে তিনি অংশ নেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে।
পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহর অভিষেক হয়। ওই বছর থেকেই নিয়মিত ক্লাব ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার হয়ে ওঠেন মাহমুদউল্লাহ। ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের জার্সিতে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাহমুদউল্লাহর। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর কেনিয়ার বিপক্ষে শুরু হয় টি-টোয়েন্টি যাত্রা। দুই বছর পরে ২০০৯ সালে টেস্ট ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার।
গৌরবোজ্জ্বল সময়
বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে ১৬ বছর পার করেছেন মাহমুদউল্লাহ। এই সময়ে অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে তিনি দারুণ রোমাঞ্চিত সময় ভক্তদের উপহার দিয়েছেন। টেস্টে অভিষেক ম্যাচে মাত্র ৯ রান দিয়ে শুরু করা ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে অপরাজিত ১৫০ রান করে। দুই ম্যাচেই সুখস্মৃতি রয়েছে মাহমুদউল্লাহর। দুটিতেই বাংলাদেশ পেয়েছে জয়। আর নিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচে বল হাতে মাহমুদউল্লাহ গড়েছিলেন ইতিহাস। দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি তুলে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট।
জাতীয় দলে নিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে দলীয় ব্যাটিং ব্যর্থতার দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেন মাহমুদউল্লাহ। সেদিন বাংলাদেশ জয় না পেলেও ক্রিকেট পরিচিতি পান মাহমুদউল্লাহ।
এদিকে প্রতিপক্ষ কেনিয়া হলেও টি-টোয়েন্টির অভিষেক ম্যাচে ভালো করতে পারেননি তিনি। তবে দলের জয়ে সেদিনের হতাশা ভুলে যান ভক্তরা।
এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সিতে ৩৮৯ ম্যাচ খেলে ৯ হাজার ৯৮৬ রান করেছেন মাহমুদউল্লাহ। এর মধ্যে ৮টি সেঞ্চুরি ও ৪৯টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে তার। টি-টোয়েন্টিতে ১২১ ম্যাচ খেলে ২ হাজার ১২২ রান পেয়েছেন। যেখানে সর্বোচ্চ অপরাজিত ৬৪ রান করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধ। আর বল হাতে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে নিয়েছেন ৩৮ উইকেট। ওয়ানডেতে ২১৮ ম্যাচে তার রান ৪ হাজার ৯৫০। সেঞ্চুরি রয়েছে তিনটি। উইকেট সংখ্যা ৮২টি। টেস্টে মাহমুদউল্লাহ খেলেছেন ৫০ ম্যাচ। ৫ সেঞ্চুরিসহ রান এসেছে ২ হাজার ৯১৪।
ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহ পরিচিত তার ধীর স্থির ব্যাটিংয়ের জন্য। ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যার নজির দেখেছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। সেই ম্যাচটিতে ২২৫ রানের জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে ১৬৯ রানেই ৮ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। তবে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে সেদিন মাহমুদউল্লাহ ম্যাচ জয়ের পেছনে ভূমিকা রাখেন। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে সেদিন দুর্দান্ত খেলেছিলেন পেসার শফিউল ইসলাম।
এ ছাড়া ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বৈশ্বিক কোনো আসরে সেঞ্চুরি করেন মাহমুদউল্লাহ। ৯ মার্চ অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষের সেই ম্যাচ এখনও ভুলে যাননি ভক্তরা। ১৩৮ বলে ১০৩ রানের ইনিংস। যার কারণে আরও একবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ধাক্কা খেতে হয় ইংলিশদের। বিশ্বকাপের ওই আসরে ইংল্যান্ডের পরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও সেঞ্চুরির দেখা পান মাহমুদউল্লাহ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন ১২৩ বলে অপরাজিত ১২৮ রান করেন এই ‘সাইলেন্ট কিলার’।
প্রায় ছয় বছর আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের জাত আরও একবার চিনিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ব্যাটিং ব্যর্থতার সেই ম্যাচে সাকিবের সঙ্গে জুটি বেঁধে জয় ছিনিয়ে নেন মাহমুদউল্লাহ। তিনি ১০৭ বলে অপরাজিত ১০২ রান করেছিলেন।
ঘরের মধ্যে দ্বন্দ্ব
মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ড আর কোচিং প্যানেলের বায়বীয় দ্বন্দ্ব তার রোমাঞ্চিত ক্যারিয়ারে বাধা তৈরি করে। কখনও ফর্মে না থাকায়, কখনও দ্বন্দ্বের জেরে ভুগতে হয়েছে ভরসার প্রতীক হয়ে থাকা মাহমুদউল্লাহকে। এখনও যার রেশ রয়ে গেছে। দল থেকে বাদ, অধিনায়কের পদ থেকে ছিটকে পড়া সবকিছুই দেখতে হয়েছে তাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কোচের দায়িত্বে রয়েছেন চান্ডিকা হাথুরুসিংহে। প্রথম মেয়াদে থাকা অবস্থায় হাথুরুসিংহে যখন বিদায় নিয়েছিলেন, তখন বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ চলছিল বলে গুঞ্জন ওঠে। বিশেষ করে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কথা উল্লেখ করতেই হয়। রিয়াদকে মাঠে নামানোর বিষয়ে হাথুরুর দোটানা চরিত্র মন ভেঙেছিল ভক্তদের। পরে মাশরাফীর হস্তক্ষেপে কিছুটা শান্ত হয়েছিল পরিস্থিতি।
দলের নির্বাচকদের মধ্যেও মাঝে মধ্যে মাহমুদউল্লাহর বিষয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কিংবা মন্তব্য করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে দল ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে মাহমুদউল্লাহর চেয়ে ফর্মে পিছিয়ে থেকেও কয়েকজন সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টিকে ক্রিকেট বোদ্ধারা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখছেন।
কয়েক মাস আগে মাহমুদউল্লাহর বিষয়ে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছিলেন, ‘রিয়াদের প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। সে জাতীয় দলের হয়ে অনেক ভালো ভালো খেলা আমাদের উপহার দিয়েছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের একটা পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী এক বছরের এই অনুযায়ী এগিয়ে যেতে চাই। যদিও গতিপথটা একটু ভিন্ন।’
নির্বাচকের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্যের পরে অনেকেই ধরে নিয়েছেন মাহমুদউল্লাহর জাতীয় দলের জার্সিতে হয়তো নিয়মিত দেখা যাবে না। যদিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরোয়া সিরিজে তিনি খেলেছেন। তারপরও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষের সিরিজে আবার তাকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু দেখা গেছে দলে এমনও কয়েকজন খেলোয়াড় রাখা হয়েছে যাদের থেকে এখনও এগিয়ে রয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। বিষয়টিকে অনেকেই ঘরোয়া দ্বন্দ্বের ফলাফল হিসেবে দেখছেন। তবে কী সেই দ্বন্দ্ব তা এখনও পরিষ্কার নয়।
টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায়
ক্যারিয়ারে এমন টানাপোড়নের ক্ষোভ থেকে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন মাহমুদউল্লাহ। তবে বিদায়ী ম্যাচকে রাঙিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে ভুল করেননি তিনি। ২০২১ সালের ৭ জুলাই হারারেতে নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন মাহমুদউল্লাহ। যেটি ছিল তার ৫০তম টেস্ট ম্যাচ। সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করে অপরাজিত ১৫০ রান করেন রিয়াদ।
ফর্ম হারিয়ে যাওয়া এবং শেষ আবেদন
এক সময়ে ভারতের ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গে তুলনা করা হতো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। কিন্তু ধীরগতির ব্যাটিংয়ের কারণে আধুনিক ক্রিকেটে তার সমালোচনা হয়েছে বেশ তোড়জোরেই। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই জাতীয় দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ। সেই পালে হাওয়া লাগে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে হুট করেই তারকা ক্রিকেটারকে দল থেকে বাদ দেয়ায়।
সবাই ধরে নিয়েছিল, এই বুঝি জাতীয় দল থেকে চিরতরে বাদ পড়লেন ডানহাতি এ ব্যাটার। তবে বোর্ডের পক্ষ থেকে তখনই জানিয়ে দেয়া হয়, সিনিয়র এ ক্রিকেটারকে বিশ্রাম দিতেই নেয়া হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত।
তবে বিশ্রামের পেছনে যে রিয়াদের ফর্মহীনতা রয়েছে, সেটি হলফ করে বলার দরকার পড়ে না। এটি জানেন মাহমুদউল্লাহ নিজেও। জাতীয় দলের হয়ে মাহমুদউল্লাহর যেমন অর্জন রয়েছে, তেমনি ব্যর্থতার পরিমাণও কম নেই। কিন্তু দিনশেষে এমন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের অযত্ন ভক্তদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করে। এ বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা রাখা উচিত। হয়তো লাল-সবুজের চিরচেনা জার্সিতে আর কমই দেখা যাবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই খেলোয়াড়কে। তবুও শেষটা যেন স্বস্তির হয় এমনটিই প্রত্যাশা কোটি কোটি ক্রিকেট পাগল বাঙালির।