সেবা দ্রুত বাড়াতে ৯৯৯-এ যুক্ত হচ্ছে কলার লোকেশন ট্র্যাকার
নিউজ ডেস্ক:
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯- এ চালু হচ্ছে ‘কলার লোকেশন ট্র্যাকার’। এতে সেবাপ্রত্যাশিরা আরো দ্রুত সেবা পাবেন।
বন-জঙ্গল কিংবা গভীর সমুদ্রে পথ হারালে নিজেদের সঠিক অবস্থান বলতে পারতেন না সেবাপ্রার্থীরা। কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচয় জানাতেও চলে যেত অনেকটা সময়। এসবের মধ্যে অযাচিত কিছু ফোন কলের ঝক্কিও সামলাতে হতো ৯৯৯ কর্তৃপক্ষকে। এসব সমস্যা সমাধানে চালু হচ্ছে কলার লোকেশন ট্র্যাকার। নাম-ঠিকানা-অবস্থান না বলতে পারলেও জাতীয় সেবা দেওয়া এ কর্তৃপক্ষ সহজে পৌঁছে যাবে সেবাপ্রত্যাশীর কাছে।
২০২১ সালে তিনদিন ধরে গভীর সমুদ্রে ভাসছিলেন ১৭ জেলে। ট্রলারের ইঞ্জিন ঠিক করতে চেষ্টার কমতি ছিল না। কিছুতেই কাজ হয়নি। শেষ হয়ে গিয়েছিল খাবার। ছিল না মোবাইলের নেটওয়ার্ক। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সাগরে ভাসতে ভাসতেও হাল ছেড়ে দেননি জেলেরা। পাল তুলে হাল ধরে মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে আসার চেষ্টা করেন। এরপর সাগরে ভাসতে ভাসতে মাস্টার আব্দুর রহমান হঠাৎ দেখতে পান মোবাইলে নেটওয়ার্ক এসেছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করেন। কিন্তু ঠিকমতো বলতে পারছিলেন না সমুদ্রের কোন জায়গায় আছেন তারা।
পরে ৯৯৯ থেকে জরুরি উদ্ধারের কল পেয়ে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থেকে সাগরপথে আনুমানিক পাঁচ মাইল দূরে মাঝ সমুদ্র থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘অনুসন্ধান’ ১৭ জন জেলেকে উদ্ধার করে।
‘কলার লোকেশন ট্র্যাকার’ সংক্রান্ত অসংখ্য বিড়ম্বনার মধ্যে আরো একটি ঘটে কক্সবাজারে। কক্সবাজারের ছেলে অভীক পাল ও তার তিন বন্ধু যখন হিমছড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেন, ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা। সোজা পথে না গিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে যাবেন এমনটাই ইচ্ছা। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের শেষটা যে এমন হবে কে জানতো? শেষ পর্যন্ত অভীক ও তার তিন বন্ধু সাইমুম আলম রাফসান, মিজবাহ ও আবির শাহ বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। তবে তাদের ৯৯৯-এর সহায়তা নিতে হয়। শুধু তাই নয়, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ৯৯৯-কে ঠিকমতো লোকেশন দিতে পারছিলেন না তারা। এরপর তাদের উদ্ধারে উড়ে যায় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলার লোকেশন ট্র্যাকার না থাকায় ৯৯৯-এ ফোন করলে গ্রাহককে তার নাম-ঠিকানা বলতে হতো। গভীর রাতে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় পড়লে, গভীর সমুদ্রে নৌযান চলে গেলে অথবা ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে গহীন অরণ্যে হারিয়ে গেলে সঠিক লোকেশন কেউ বলতে পারতো না। এতে ৯৯৯ কর্তৃপক্ষকে সেবা দিতে বেগ পেতে হতো।
এছাড়া অকারণেও বহু মানুষ ফোন করেন ৯৯৯-এ। ভূতুড়ে ফোনও (কল করে কথা বলে না) করেন অনেকে। কেউ কেউ ফোন করে বলেন, তার বাচ্চা খেতে চাইছে না, এটার সমাধান কী? এছাড়া ফোন করে সেবা না চেয়ে নারী কণ্ঠ পেলে উদ্ভট কথাবার্তা বলেন কেউ কেউ। মিসড কল দেওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। একই নম্বর থেকে একাধিকবার ব্লাঙ্ক কলও দেওয়া হয়। এসব ফোন নম্বরে ৯৯৯ থেকে সতর্ক করে পাঠানো হয় মেসেজ। এরপরও বারবার ফোন করে বিরক্ত করলে সেই নম্বর ব্লক লিস্ট করে রাখা হয়।
এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ৯৯৯-এ যুক্ত হচ্ছে কলার লোকেশন ট্র্যাকার। গ্রাহকের লোকেশন ও পরিচিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে ৯৯৯ সংশ্লিষ্টদের কাছে। সময় নিয়ে গ্রাহকের নাম-ঠিকানা বলা লাগবে না। এতে যেমন গ্রাহকের সময় বাঁচবে, অন্যদিকে আরো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেবা দিতে পারবে ৯৯৯। এছাড়া বিরক্তিকর কল এড়াতেও কলার লোকেশন ট্র্যাকার কাজে আসবে।
৯৯৯ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর সেবাটি চালুর পর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৬১টি কল এসেছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮২টি কল সরাসরি সমাধানযোগ্য ছিল।
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, মোট কলের ১ কোটি ৮০ লাখ ৬৬ হাজার ৬২২টির বিপরীতে কোনো না কোনোভাবে সার্ভিস দেওয়া হয়েছে, যা মোট কলের ৪১ দশমিক ২০ শতাংশ।
পাশাপাশি ৯৯৯ এ অপ্রয়োজনে অনেকে ফোন করছেন। দিচ্ছেন মিথ্যা তথ্যও। গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে ট্রিপল নাইনে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৯টি অপ্রয়োজনীয় কল এসেছে, যা মোট কলের ৫৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে বিরক্তিকর কলই ছিল ২৩ লাখ ১১ হাজার ৯৬৫টি।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই বিরক্ত করা কলের জন্য দণ্ডের বিধান রেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ এর ধারা ৭০ (১) সংশোধন করা হয়। এই আইনে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কল দিলে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। এমনকি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেও বিরক্তিকর কলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সত্যিকারের বিপদগ্রস্তদের দ্রুত সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে চালু করা হচ্ছে কলার লোকেশন ট্র্যাকার। এতে অপ্রয়োজনীয়, মিথ্যা তথ্য বা বিরক্তিকর কল কমে যাবে। ৯৯৯-এর কর্মী বাহিনী দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জনগণকে নির্বিঘ্নে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। দেশের সব মেট্রোপলিটন এলাকায় এমডিটি (মোবাইল ডাটা টার্মিনাল) ও টিডিএস (থানা ডেসপাস সিস্টেম) চালু করার ফলে সেবাটি আরো সহজ হয়েছে।
৯৯৯ সেবা বর্তমানে একসঙ্গে ৮০টি কল রিসিভ করতে পারে। প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার কল আসছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই সার্ভিসযোগ্য কল।
৯৯৯-এর একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে ৪৩০ জন কর্মকর্তা জনগণের সেবায় কাজ করছেন। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের সঙ্গে সমন্বয় করে ৯৯৯-কে অটোমেশন করা হচ্ছে। এটি চালু হলে সময় কমে যাবে, দ্রুত সার্ভিস দেওয়া যাবে। রেসপন্স টাইম যত কম লাগবে, ততই দ্রুত জনগণকে সেবা দেওয়া যাবে। ৯৯৯-এর মূল লক্ষ্য জনগণকে অল্প সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া।
৯৯৯-এর পরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) আনোয়ার সাত্তার বলেন, শিগগির অটো কলার লোকেশন ট্র্যাকার সংযুক্ত হচ্ছে। যিনি কল করবেন তার অবস্থান আমরা জেনে যাবো, এতে কলারের সেবা দেওয়া আরো সুবিধা হবে।
তৃতীয় কোনো ব্যক্তির লোকেশন ট্র্যাকিং করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, যিনি ফোন করবেন শুধু তার লোকেশনটাই আমরা জানতে পারবো। ফোন করার পর ৯৯৯ থেকে শুধু জানতে চাওয়া হবে- ‘আপনি কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। কোথা থেকে বলছেন এটা জানতে চাওয়া হবে না’ এতে চার-পাঁচ মিনিট সময় সেভ হবে।