আটকে আছে বিশ্বব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা
অনলাইন ডেস্ক :
চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও আটকে আছে বিশ্বব্যাংকের সহজ শর্তের ঋণের প্রায় ৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। নিয়মিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক না হওয়ায় প্রকল্প অনুমোদন বিলম্ব হচ্ছে। তাই বন্ধ আছে ঋণ চুক্তির প্রক্রিয়া। অথচ ‘রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর অ্যাডাপশন অ্যান্ড ভারনাবিলিটি রিডাকশন প্রজেক্ট (রিভার)’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য প্রায় ৮ মাস আগেই ঋণটির অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড।
তবে ইতোমধ্যেই প্রকল্পটির অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করেছ পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু কবে নাগাদ এটি পাশ হবে সেটি এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ডলার সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক অর্থ আছে এমন প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন ও বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, রিভার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৪ হাজার ৩২৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক তাদের সহজ শর্তের তহবিল ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে ঋণ দেবে ৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। বাকি ৪৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা খরচ করা হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
এই ঋণ পেতে গত বছরের ২৩ মে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে নেগোশিয়েশন (আলোচনা) শেষ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৬ জুলাই ঋণটি অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। কিন্তু জটিলতা দেখা দেয় প্রকল্পটি অনুমোদন না পাওয়ায়। এ কারণে চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে আছে। একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের পরই ঋণ চুক্তির দিনক্ষণ ঠিক হবে। এটির অনুমাদন যতই দেরি হবে ততই ঋণচুক্তিও পিছিয়ে যাবে।
এমনটিই জানান ইআরডির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা। ইআরডির এক কর্মকর্তা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, একনেকে অনুমোদন না হলে আমরা ঋণচুক্তির কার্যক্রম শুরু করতে পারছি না। অনুমোদন পেলেই পরবর্তী কাজগুলো শুরু হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণ শেষ করা হয়েছে। বর্তমানে এটি একনেক অনুবিভাগে আছে। ১২ মার্চ একনেক বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনা করে উপস্থাপন হতে পারে। আশা করছি অনুমোদনে আর বেশি দেরি হবে না।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে শুরু করে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এটির আওতায় ৫০০টি বহুমুখী বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, অ্যাক্সেস রাস্তা এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে নদী ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাভাবিক সময় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এসব অবকাঠামোতে সৌরশক্তি ব্যবস্থা, পানি, স্যানিটেশন এবং নানান স্বাস্থ্য সুবিধা থাকবে। নারী ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে।
প্রকল্পটি বন্যার প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া এবং আচরণগত পরিবর্তনের পদক্ষেপে সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা জোরদারে সহায়তা করবে। প্রকল্পের অন্যান্য কার্যক্রম হলো-১০০টি সৌরশক্তি চালিত ক্ষুদ্রাকার গ্রিড স্থাপন করা হবে। এছাড়া ২৫০টি মাঠ উঁচুকরণ, ২৭৫ কিলোমিটার বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র সংযোগ সড়ক উন্নয়ন, ৫০০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ, ১ হাজার ৩৩০ মিটার কালভার্ট নির্মাণ এবং ১১০টি কমিউনিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংযোগ সড়ক উন্নয়ন করা হবে। আরও আছে ১৫টি নৌ ঘাট তৈরি, সড়কে সৌরবাতি স্থাপন এবং বজ নিরোধক যন্ত্র স্থাপন করা হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা তো অনেকে আগেই ঋণটি অনুমোদন দিয়েছি। তবে সাধারণ প্র্যাকটিস হচ্ছে একনেকে প্রকল্প পাশ না হলে ঋণচুক্তি করা হয় না। কেননা চুক্তি হওয়া মানেই ঋণটি কার্যকারিতা শুরু হয়ে যাওয়া। কিন্তু তখন পর্যন্ত যদি প্রকল্পই অনুমোদন না পায় তাহলে এক টাকাও খরচ করা যাবে না। এক্ষেত্রে চুক্তি করে তো কোনো লাভ নেই। ‘রিভার’ প্রকল্পটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ফলে এর অনুমোদন হওয়াটা জরুরি।
বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে, বাংলাদেশ একটি নিম্নাঞ্চলীয় ব-দ্বীপ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়সহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বন্যার মাত্রা ও তীব্রতা বাড়ছে। প্রতি বছর বন্যা এবং নদীভাঙনে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে।
এ অবস্থায় নতুন এ প্রকল্পটি তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা এবং সুরমা ও মেঘনা নদীর অববাহিকার অত্যন্ত বন্যাপ্রবণ জেলাগুলোর জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সাহায্য করবে। জেলাগুলো হলো- নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। এসব জেলার ৭৮টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলমান সংকটের আগে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার একনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। তখন প্রকল্প অনুমোদন দ্রুত হয়ে যেত। কিন্তু সংকট শুরু হওয়ার পর একনেক বৈঠক কমে যায়। শুরুতে দুই সপ্তাহে একটি করে একনেক হলেও বর্তমানে মাসে একটি করে একনেক বৈঠক হচ্ছে। সর্বশেষ ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় একনেক বৈঠক।
এরপর ফেব্রুয়ারিতে কোনো একনেক হয়নি। ১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠক। সেখানে শুধু চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি অনুমোদন পাবে। এভাবে নিয়মিত একনেক না হওয়ায় তৈরি হয়েছে প্রকল্প জট।