রপ্তানি বৃদ্ধিতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিকল্প নেই

অনলাইন ডেস্ক :

২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া মাত্রই স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে প্রাপ্ত বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এসব সুবিধা হারালে বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা প্রতিরোধে এখন থেকেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা বাঞ্ছনীয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ও বিদেশি বাণিজ্যের সম্প্রসারণে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। টেকসই সমাধানের অংশ হিসাবে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। ইতঃপূর্বে বেশকিছু আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হলেও সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। তাই দ্বিপাক্ষিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়েই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দরকষাকষি করছে বাংলাদেশ। লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় নিয়ে বিদেশের বাজারে দেশীয় পণ্যের শুল্কমুক্ত অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পিছিয়ে পড়তে হবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য ও স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বর্তমানে ৩৮টি উন্নত দেশে একতরফা সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারে; অর্থাৎ এসব দেশকে কোনো ধরনের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করা ছাড়াই বাংলাদেশ তাদের বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি করতে পারে। একতরফা এ সুবিধার বাইরেও বাংলাদেশ কয়েকটি আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তিতে সই করেছে। মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আওতায় একাধিক দেশের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে পণ্য রপ্তানি করা যায়। অন্যদিকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের শুল্ক মওকুফ বা শুল্কহার হ্রাস করা হয়ে থাকে।

একমাত্র কার্যকর মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হিসাবে বাংলাদেশ ‘দক্ষিণ এশিয়া মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল’ বা সাফটার সদস্য। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মুক্তবাণিজ্যের চুক্তি হিসাবে ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর, যা আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে খুব বেশি অবদান রাখতে পারেনি। চুক্তির আওতায় প্রত্যেকের সেনসিটিভ তালিকাভুক্ত কিছুসংখ্যক পণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একে অপরকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে থাকে।

১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল ইকোনমিক কো-অপারেশন’ বা বিমস্টেক এর সদস্য। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মুক্তবাণিজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে ২০০৪ সালে বিমস্টেক-এর অর্থনৈতিক রূপরেখা গৃহীত হলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। তবে কার্যকর হলে ১০ শতাংশ পণ্য ব্যতীত বাকিসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে সদস্য দেশগুলো।

দুটি মুক্তবাণিজ্য জোটের সদস্য ছাড়াও বাংলাদেশ কয়েকটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তিতে সক্রিয় রয়েছে। ‘এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তি’ (আপটা) এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ও কার্যকর বাণিজ্য চুক্তি। অপর দুটি অগ্রাধিকারমূলক চুক্তি হলো, ওআইসি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য অগ্রাধিকার চুক্তি ‘টিপিএস-ওআইসি’ এবং ‘ডি-৮ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি’।

মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীন ও ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। দুটি মুক্ত ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ অধিকাংশ পণ্য শুল্কমুক্তভাবে আমদানি-রপ্তানি করতে পারে। উপরন্তু ২০২২ সাল থেকে চীন বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছে। তবে শুল্ক ছাড়ের ফলে এসব দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি। গবেষণা বলছে, আপটা ও সাফটা চুক্তি আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যে সামান্য প্রভাব ফেলেছে, চীন ও ভারত তার সিহংভাগ সুবিধা পেয়েছে। ফলে দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান বেড়ে ১৭.৮২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ভারতের সঙ্গে ঘাটতি হয়েছে ১১.৭০ বিলিয়ন ডলার। ভারতে বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য পাটজাত পণ্যের ওপর ২০১৭ সাল থেকে এন্টি ডাম্পিং শুল্কারোপের ফলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় আমেরিকা ও ইউরোপের রপ্তানি বাজারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের পণ্যের সিংহভাগ এসব দেশে রপ্তানি করলেও আমদানির পরিমাণ নগণ্য। ফলে এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে পারলেই তা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। এসব দেশে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। দেশটি ইতোমধ্যেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি সম্পন্ন করায় ২০২৬ সালের পর থেকে ইউরোপের দেশগুলোয় শুল্কমুক্তভাবে পণ্য রপ্তানি করতে পারলেও বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৯ শতাংশ শুল্ক বসবে, যা বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা হ্রাস করবে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন চুক্তি করা না হলে ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে ২২ শতাংশ। সুতরাং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের সামনে কোনো পথ খোলা নেই।

বাংলাদেশের বিদ্যমান আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তিগুলো বাস্তবে ফলপ্রসূ না হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি এফটিএ উইং খোলা হয়েছে, যারা কোনো দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার পূর্বে চুক্তির লাভ-ক্ষতির সম্ভাব্যতা যাচাই করে থাকে। ২০২৪ সালের মধ্যে অন্তত ১৫টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি হবে বলে জানিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতসহ ১৭টি দেশের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব চুক্তির অনেকগুলোই আলাপ-আলোচনার শেষ পর্যায়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো দ্বিপক্ষীয় এফটিএ চূড়ান্ত হয়নি। সর্বশেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মিটিংয়ের ফাঁকে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে একমত হয়েছেন। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম এফটিএ। কম্বোডিয়ার সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সেখানে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া সে দেশের কৃষি খাতে বিনিয়োগের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশ এসেছে পোশাক রপ্তানি থেকে। অন্যদিকে রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম তাদের রপ্তানি বাজারকে শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল না রেখে বহুমুখীকরণ করেছে। ইতোমধ্যে ১৪টি দেশের সঙ্গে তাদের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি কার্যকর রয়েছে। যেসব দেশে রপ্তানির সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র রয়েছে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে, সেসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সহজ করতে পারলে তা বাজার বহুমুখীকরণে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। অনেকগুলোর কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। অনেক দেশই এসব জোনে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে এসেছে। ফলে রপ্তানি খাত বহুমুখীকরণ এবং সম্ভাবনাময় খাতগুলোয় বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের জন্য এফটিএ অত্যন্ত জরুরি।

চ্যালেঞ্জ

মুক্তবাণিজ্য চুক্তির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, এখানে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশের ৯০ শতাংশ পণ্য ও প্রায় সব সেবার প্রবেশাধিকার শুল্কমুক্ত করতে হবে। ফলে এ খাত থেকে রাজস্ব হারাবে বাংলাদেশ। যেমন : বাংলাদেশে স্টিল আমদানির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত রয়েছে, যা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশ পাবে না। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ছাড় দেওয়ার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। ফলে যেসব দেশে বাংলাদেশের রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি, সেসব দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে আপত্তি জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

মুক্তবাণিজ্য চুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য শুধু শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান নয়; বরং ট্রেড লিবারেলাইজেশনের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজীকরণ। শুল্কহার হ্রাস ছাড়াও অন্যান্য অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ এবং আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি মুক্তবাণিজ্য চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য। এগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া মুক্তবাণিজ্যের সুফল ঘরে তোলা যাবে না।

উন্নত বন্দর ও পরিবহণ অবকাঠামোর অভাব আমদানি-রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। দক্ষ মানবসম্পদ ও জনবলের ঘাটতিও মুক্তবাণিজ্যকে ফলপ্রসূ করার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাণিজ্যিক নীতি সহজীকরণ, ব্যবসায়িক ব্যয় হ্রাস, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, সর্বোপরি ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)