কাটছাঁট হচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ

অনলাইন ডেস্ক :

এবারও বৈদেশিক সহায়তার হিসাব থেকে বড় অঙ্কের অর্থ কাটছাঁট হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাদ যেতে পারে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) থেকে এ বরাদ্দ কমতে পারে। মূল এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা (ঋণ ও অনুদান) খরচের লক্ষ্য আছে ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা। সেখান থেকে কমিয়ে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হতে পারে ৮০ হাজার ২০ কোটি টাকা। তবে এখনো চূড়ান্ত হিসাব না হওয়ায় টাকার অঙ্ক কম বা বেশি হতে পারে বলে মনে করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে বরাদ্দ নির্ধারণের কাজ করছে ইআরডি। এ অবস্থায় ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ইআরডির কাছ থেকে চূড়ান্ত হিসাব চেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। কিন্তু ইআরডি থেকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ১৫ জানুয়ারির পর আরও ৫-৬ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।

ইআরডির একাধিক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই সংশোধিত এডিপির একটি খসড়া হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এটি আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোয় পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে কিছু মন্ত্রণালয় বরাদ্দ বাড়ানোর এবং কিছু মন্ত্রণালয় আরও কমানোর অনুরোধ করেছে। তবে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত বরাদ্দের বিষয়টি এখনো জানানো হয়নি।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বাজেটকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখার একটা প্রবণতা সব সরকারেরই থাকে। এমন অবস্থা থেকে বছরের শুরুতেই বাস্তবতা চিন্তা না করেই বরাদ্দ বাড়িয়ে ধরা হয়। এতে বাজেটে বিশ্বস্ততা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া যেসব মন্ত্রণালয় বরাদ্দ চেয়ে নেয়, তারাও পরবর্তী সময়ে ঠিকমতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে না। কারণ, কর্মকর্তারা জানেন যে অর্থবছরের মাঝপথে কমানো যাবে। কমিয়ে যে বরাদ্দ নেওয়া হবে, সেটিও খরচ করতে পারেন না তারা। এক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে বছরের পর বছর একই চিত্র বিরাজ করছে।

ইআরডি সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ নির্ধারণে ১৪ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চারদিনের সিরিজ বৈঠক করেছে ইআরডি। এ সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১১৮টি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এসব বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ইআরডির সচিব শরিফা খান। সেখানেই কোন প্রকল্পের বিপরীতে কার কত চাহিদা, সেটি জানতে চাওয়া হয়। এ সময় মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরাসহ প্রকল্প পরিচালকরাও উপস্থিত ছিলেন। এরও আগে লিখিতভাবে আরএডিপিতে বরাদ্দ চাহিদা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সঠিক বরাদ্দ নির্ধারণ করা যায়নি এখনো।

ইআরডি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো অর্থবছরই মূল এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক থাকেনি। পরবর্তী সময়ে অর্থবছরের ৬ মাস যেতে না যেতেই বড় অঙ্কের বরাদ্দ ছেঁটে ফেলতে হয়। তবে এক্ষেত্রে গত অর্থবছর (২০২১-২২) কাটছাঁট করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এ অর্থবছর মোট বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ২৪ কোটি টাকা। সেখান থেকে বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয় ৭২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ কমানোর রেকর্ড তৈরি হয়। করোনা মহামারির কারণে এ অর্থবছর বাদ দেওয়া হয় ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা।

এ সময় মূল এ ডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংশোধিত বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকায়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল এডিপিতে ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এডিপি সংশোধনের সময় ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমানো হয়। বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাদ দেওয়া হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমানো হয় ৮ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন এক্ষেত্রে তিন পক্ষের সমন্বয়ের অভাব আছে। যেমন ইআরডি হয়তো মনে করে তারা অনেক বেশি বৈদেশিক সহায়তা আনতে পারবে। কিন্তু যখন প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়, তখন বেশ সময় লেগে যায়। দেখা যায়, সংস্থাগুলো প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে দেরি করে বা ঠিকমতো প্রস্তাব আসে না।

আবার পরিকল্পনা কমিশন যেসব সুপারিশ দেয় সেগুলো প্রতিপালন করে আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পাঠাতে দেরি করে। ফলে সবকিছু মিলিয়ে অনেকটা সময় চলে যায়। এজন্য ইআরডি, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং পরিকল্পনা কমিশনের মধ্যে ত্রিমুখী সমন্বয় থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে ঋণদাতা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা আছে, যারা প্রকল্প অনুমোদন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স দিতে দেরি করে। তারা নানা ধরনের কাগজপত্র চেয়ে বসে। ফলে সেগুলো যোগাড় করতেই বেশ সময় লাগে। পাশাপাশি বাস্তবায়ন পর্যায়ের বিভিন্ন জটিলতা তো আছেই।

ইআরডি, আইএমইডি এবং পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, অর্থবছর শুরুর আগেই বিভিন্ন প্রকল্পের অনুকূলে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ বাড়িয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তবায়ন পর্যায়ে দেখা দেয় নানা জটিলতা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প তৈরিতেই দুর্বলতা এবং দক্ষতার অভাব।

এছাড়া যেনেতেনভাবে প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব, নিয়মিত ও কার্যকরভাবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) বৈঠক না হওয়া। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সূত্রতা, উন্নয়নসহযোগীদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব। আরও আছে প্রয়েজনীয় অর্থছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি ইত্যাদি কারণ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)