সাতক্ষীরায় দিনেদুপুরে প্রধান শিক্ষকের আত্মহত্যা
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :
পুলিশ আম গাছ থেকে এক প্রধান শিক্ষকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে। বুধবার দুপুর দুইটার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গোপালপুর পিকনিক কর্ণারের পাশে ভায়রা ভাই ইটালী প্রবাসী সাঈদের বাড়ির সামনের আমগাছ থেকে গলায় তোয়ালে পেচানো এ লাশ উদ্ধার করা হয়।
মৃতের নাম আবুল বাসার (৫০)। তিনি শ্যামনগর উপজেলার কৈখালি গ্রামের মৃত এন্তাজ আলীর ছেলে ও কৈখালি সামছুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
কৈখালি সামছুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য আলী মোর্তজা জানান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম সভাপতি থাকাকালিন গত বছরের ১৩ ফেব্রæয়ারি নিয়োগ পরীক্ষায় পশ্চিম কৈখালি গ্রামের বিমল মিস্ত্রীর ছেলে দীলিপ কুমার মিস্ত্রীকে অফিস সহায়ক, তার বউদি মিনতি রানী মিস্ত্রীকে আয়া, একই গ্রামের নেপাল মÐলের ছেলে নিমাই কুমার মÐলকে নৈশ প্রহরী এবং যাদবপুর গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে জাহিদ হাসানকে ল্যাব সহকারি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এ নিয়োগে প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার, সভাপতি রেজাউল করিমসহ দুইজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মোটা অংকের নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। ফলে আয়া পদে নিয়োগ বঞ্চিত রেশমা খাতুনের পক্ষে মামা শ্বশুর জাকির হোসেন নিয়োগ বাতিলের দাবিতে গতবছরের ১৬ ফেব্রæয়ারি শ্যামনগর সহকারি জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন।
মামলায় সভাপতি রেজাউল করিম ও সাধারণ সম্পাদক প্রধান শিক্ষক আবুল বাসারসহ ১১জনকে বিবাদী করা হয়। আগামি ১৩ মার্চ মামলার ধার্য দিন। একইভাবে আয়াপদে নিয়োগ বঞ্চিত মোস্তফা মাহমুদের স্ত্রী মারুফা বেগম চাকুরি দেওয়ার নামে পাঁচ লাখ টাকা প্রতারণা ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। গ্রেপ্তারি এড়াতে প্রধান শিক্ষক মহামান্য হাইকোর্ট থেকে অগ্রিম জামিন নেন। আগামি ২৭ ফেব্রæয়ারি তার নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেওয়ার কথা ছিল।
আলী মোর্তজা আরো জানায়, পুরাতন কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন কমিটির সভাপতি হন কৈখালি ইউপি’র বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম। গত ১৪ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ের মাসিক সভায় মামলা থাকার কারণে কেন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে না তা জানতে চেয়ে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান শিক্ষক আবুল বাসারকে কারণ দর্শাতে নোটিশ দেওয়া হয়। এ নিয়ে প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
মৃত আবুল বাসারের ভাই আবুল খায়ের জানান, তার ভাই আবুল বাসার মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ার কারণে কয়েকদিন ধরে গোপালপুরে শ্যালিকা জোনাকির বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ছুটিতে ছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি আব্দুর রহিম স্বাক্ষরিত একটি কারণ দর্শাণোর নোটিশ পান ভাই আবুল বাসার। সেখানে বিগত নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন চাকুরিপ্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়া প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা ফিরিয়ে না দিলে চাকুরি থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ভাই। বুধবার দুই ছেলে নানার বাড়ি চলে যাওয়ার পর স্ত্রী ঔষধ কিনতেযাওয়ার পরপরই বাসার আত্মহত্যা করেছে বলে মনে করছেন তিনি।
শ্যামনগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী মৃত আবুল বাসারের শ্যালিকা জোনাকী বেগম জানান, তার দুলা ভাই স¤প্রতি তার বাড়িতে স্বপরিবারে ভাড়া থাকতো। তাদের একটি ছেলে ডিগ্রী ও অপরটি এইচএসসিতে পড়াশুনা করে। দুই ছেলে বর্তমানে নানার বাড়িতে অবস্থান করছে। দুপুর দেড়টার দিকে আপা নুরুন্নাহার বাজারে ঔষধ কিনতে যাওয়ার সুযোগে বাসায় কেউ না থাকায় দুলা ভাই আত্মহত্যা করেছে। ধারনা করা হচ্ছে বিদ্যালয়ের নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে জটিলতা তৈরী হওয়ায় দুলা ভাই আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৃত আবুল বাসারের স্ত্রী নুরুন্নাহার বুধবার বিকেলে এ প্রতিবেদককে জানান, বিদ্যালয়ে নিয়োগ দূর্ণীতি নিয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মামলা করায় সহকারি প্রধান শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দিন, সমাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক আব্দুল মান্নান ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক আব্দুল মজিদ। নেপথ্যে ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল রহিম।
একই ভাবে ওই চক্রটি মারুফাকে দিয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রতারণা ও ধর্ষণের চেষ্টার মামলা করায়। স¤প্রতি এই চক্রটি মামলা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে তার স্বামীর কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে আসছিল। তিন দিন আগেও শিক্ষক আব্দুল মজিদ তার স্বামীর কাছে টাকা চায়। চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম, শিক্ষক আব্দুল মান্নান, আব্দুল মজিদ ও সহকারি শিক্ষক সালাহউদ্দিন তার স্বামীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে।
কৈখালি ইউপি চেয়ারম্যান ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, আগের কমিটির কাছে টাকা দিয়ে চাকুরি না পাওয়ায় ও টাকা না ফেরৎ না পাওয়ার অভিযোগ পেয়ে প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শাতে বলা হয়। তবে আগের কমিটির সভাপতি রেজাউল করিম টাকা ফেরৎ দিতে রাজী না হওয়ায় প্রধান শিক্ষক বেকায়দায় পড়েন। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে প্রধান শিক্ষক আত্মহত্যা করতে পারেন।
ইউপি নির্বাচন ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে পরাজিত রেজাউল করিম প্রধান শিক্ষককের আত্মহত্যার দায় তার উপর চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিদ্যলয় পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেযারম্যান রেজাউল করিম জানান, শিক্ষক আব্দুল মান্নান, আব্দল মজিদ এবং সভাপতি আব্দুর রহিম প্রধান শিক্ষককে সরাতে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু করে। আবুল বাসারকে অপসারন ও মামলার হুমকি দিয়ে কারণ দর্শাণোর নোটিশ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম বাদল জানান, বিদ্যালয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে মামলার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় শিক্ষক আবুল বাসার আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। লাশের ময়না তদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে।