ভ‚মিহীন আবাসন কেন্দ্র থেকে ৮০০ শতাধিক ভ‚মিহীন পরিবার উচ্ছেদ, লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :
সাতক্ষীরা দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের খলিশাখালি ভ‚মিহীন পলীতে হামলা চালিয়ে ৭৮৫ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টার থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত পাঁচ ঘন্টা ধরে মুহু মুহু বোমা ও গুলি ছুঁড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় ভ‚মিহীনদের খুপড়ি খুপড়ি ঘর জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়। তাদের গরু ও ছাগল ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয় ভূমিহীন পলীর পার্শ্ববর্তী গ্রাম নোড়া ও চালতেতলাতে। এ ঘটনার পর খলিশাখালি, চালতেতলা, নোড়ার চক, নোড়ার চারকুনিসহ আশেপাশের এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
খলিশাখালি শেখ মুজিবনগর ভ‚মিহীন আবাসন কেন্দ্রের সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন ৪৩৯ দশমিক ২০ একর জমিতে তারা দখল নিয়ে ৭৮৫ পরিবার ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে বসবাস করা শুরু করে। গত এক বছর তিন মাস বসবাস করাকালীন কোনো ধরণের বিরোধের সৃষ্টি হয়নি। কিম্বা সরকার পক্ষ থেকে কখনও জমি থেকে তাদের উঠে যেতে বলা হয়নি। যাতে কেউ তাদের বসবাসে বিঘœ সৃষ্টি না করে এ জন্য হাইকোর্টের রিট পিটি শনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলরুজ্জামানের সমন্বয়ে বেঞ্চ ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি ছয় মাসের জন্য জমিতে যে যে অবস্থায় আছে তারা সেই অবস্থায় থাকবে মর্মে আদেশ দেয়।
আদেশে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সাতজনকে এ রিট পিটিশনে বিবাদী শ্রেণিভ‚ক্ত করা হয়। একই আদালত ৩১ আগস্ট থেকে এ স্থিতিশীল অবস্থার আদেশ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেয়। আদালতের বর্ধিত আদেশ রেজিষ্ট্রি ডাকযোগে পাঠানো হয় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা প্র“লশ সুপার, দেবহাটা থানা ভারপ্রাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে।
কাজী গোলাম ওয়ারেশ, ডাঃ নজরুল ইসলাম, আব্দুল আজিজ, রফিকুল ইসলামসহ ৪৩ জন জমিার মালিক দাবিবার ওই রিট পিটিশনে পক্ষভুক্ত হয়ে গত ২৩ আগষ্ট আদালতে রিট পিটিশন খারিজের আবেদন জানালে তা না’মঞ্জুর করে ১৭ নং আদালতে মামলার চুড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য বলা হয়। খলিশাখালি শেখ মুজিবনগর ভ‚মিহীন আবাসন কেন্দ্রের পক্ষে সভাপতি আনারুল ইসলাম গত ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি রিট পিটিশন(১৫০০/২২) করেন।
নোড়াচক ভ‚মিহীন সংগ্রাম কমিটির সহসভাপতি আবুল হোসেন গাজী জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে শিমুলিয়া গ্রামের কাজী গোলাম ওয়ারেশ ও সখিপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ ও ডাঃ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস রত খলিশাখালি শেখ মুজিবনগর ভ‚মিহীন আবাসন কেন্দ্রে এক হাজারের বেশি লাঠিয়াল নিয়ে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে সশস্ত্র হামলা চালায়। এর আগে তারা ভূমিহীন জনপদে ত্রাস সৃষ্টির জন্য মুহু মুহু বোমা ও গুলি ছোঁড়ে।
এ সময় তারা সাত শতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়। বাড়ির জিনিসপত্র লুটপাঠ করে। হামলা , ভাঙচুর ও লুটপাটে অংশ নেয় আহছানিয়া মিশনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ইকবাল মাসুদের লোকজন। হামলাকারিরা নিয়ে যায় গোবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি। তিনি আরও জানান, এ সময় ভ‚মিহীন পলীর বাইরে নোড়া ও চালতেতলায় যারা ভ‚মিহীনদের সহযোগিতা করতো এমন নোড়ার ইউনুচ আলী, ইরাদ আলী, ইসমাইল মেম্বরসহ ১০-১২টি পরিবারে জিনিসপত্র লুটপাট করে ঘরবাড়ি ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশ দুরে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আবুল হোসেন জানান, দরজার তালা ভেঙে তার দুটি গরু, ছয়টি হাঁম ও তিনটি মুরগী, ভাই বাবরুর একটি ছাগল, জিয়াদ আলীর দুটি ছাগল, ইসমাইল মেম্বরের বাড়ি ভাঙচুর করে ১০ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটপাট করা হয়েছে। চালতেতলার গোলাপ ঢালীর বাড়িতে লুটপাট চালানা হয়েছে।
নোড়ারচকের ইরাদ আলী জানান, তার বাড়ি ভাঙচুর করে তিনটি বাই সাইকেল, দুটি মোটর সাইকেল, দুটি টেলিভিশনসহ বাড়ির হাড়ি, পাতিল ও গ্লাসসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর আশাশুনির বদরতলা মাসের সেট থেকে তার ছেলে ইউনুসকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে পারুলিয়ায় ওয়ান শুটারগান ও তিনিটি গুলিসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী পারুলিয়ার সমছের আলী, পলগাদার হাসানুর রহমান, বদরতলার জাহেদ আলীসহ কয়েকজন জানান, জমির মালিক দাবিদারদের পক্ষে ঢাল হিসেবে নেতৃত্ব দেয় পলগাদার সাবেক ইউপি সদস্য মকরেম শেখ, পুটু, ইন্দ্রনগরের মনি ও শালখালির হাতকাটা চড়–। হামলার পর এলাকা পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি লুট করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
খলিশাখালি চরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, তার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ভাই গত ৩ নভেম্বর আদালত চত্বর থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করেন পুলিশ পরিচয়ে ধরে এনে অস্ত্র ও গুলির মামলায় জেলে পাঠানো কামরুলের বাড়ি, ভ্যান চালক ভাই আরিফুল ও হামিদ গাজীর বাড়িতে লুটপাট মেষে ভাঙচুর করা হয়েছে।
জমির মালিক দাবিদার সখিপুরের আব্দুল আজিজ মুঠোফোনে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সাংবাদিকদের জানান, তাদের পৈত্রিক জমি। এ জমি ভ‚মিহীন নামধারী কিছু সন্ত্রাসী দেড় বছর আগে দখল করে নিয়ে ছিল। মঙ্গলবার তারা তাদের জমি দখলে নিয়েছেন। এ সময় তারা ভ‚মিহীন ও তাদের সহযোগীদের ঘরবাড়িতে লুটপাট, ভাংচৃর ও জ¦ালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভ‚মিহীনরা চলে যাওয়ার নিজেদের ঘরবাড়িতে নিজেরা আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়ে গেছে।
দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ ওবায়দুল্লাহ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, খলিশাখালি ভ‚লিতে বিরোধ হচ্ছে এ মর্মে ৯৯৯ এ ফোন পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ধরণের সংঘর্ষ ছাড়াই জমির মালিকরা তাদের জমি দখল নিয়েছে। কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরণের অভিযোগ থানায় কেউ করেনি।