মেয়ের সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন ৪ সন্তানের জননী
নিউজ ডেস্ক:
মারুফা আকতারের অল্প বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। সবার মতো তারও শুরু হয় সংসার জীবনের ব্যস্ততা। তবে বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এবার মেয়ের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন চার সন্তানের জননী মারুফা।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে চলতি বছর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিমলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নেন। আর তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা একই প্রতিষ্ঠান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ডিমলা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষা দেন।
এর দুই বছর আগে মেয়ের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষাতে জিপিএ ৪ দশমিক ৬০ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হন মারুফা। ২০০৪ সালে এসএসসি দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু পরীক্ষার আগেই অভিভাবকেরা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন।
অদম্য এ নারী নীলফামারী ডিমলার খালিশা চা পানি ইউনিয়নের পুন্যারঝার গ্রামে সাইদুল ইসলামের স্ত্রী। মারুফার স্বামী পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী। দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে মেয়ে শাহী সিদ্দিকা বড়। দ্বিতীয় ছেলে দশম শ্রেণি, তৃতীয় মেয়ে অষ্টম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
জানা গেছে, মারুফা আকতার উপজেলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয়ের বিএম শাখা থেকে ও তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা একই কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় একসঙ্গে অংশ নিয়ে মেয়ের চেয়ে ভালো ফলাফল করেন মারুফা আকতার। তিনি এসএসসিতে জিপিএ-৪.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন এবং তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা পেয়েছিলেন জিপিএ-৩।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে দশম শ্রেণিতেই লেখাপড়ার ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে রেখে মারুফা আকতারকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বিয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। পিঠাপিঠি চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতেই চলে যায় ১৫টি বছর। সচরাচর কোনো কিশোরীর লেখাপড়ার ইচ্ছেশক্তি আর এতো বছর বাঁচে না। কিন্তু মারুফা আক্তার দেখিয়েছেন কীভাবে জয় করা যায়। তিনি এবার নিজ মেয়ের সঙ্গেই এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
নতুন করে পড়াশোনা শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে মারুফা আক্তার বলেন, ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি ছিল আমার খুব আগ্রহ ছিল। অভাবের সংসারে বড় হয়েছি। ২০০৩ সালে যখন এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। ইচ্ছা থাকলেও প্রতিবাদ করে পড়াশোনাটা করতে পারিনি। তবে পড়াশুনার তাড়না মনে দাগ কেটেছে সব সময়।
তিনি বলেন, বিয়ের পর চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের পড়ার কথা ভাবার সময়ই হয়নি। পরে নিজের অদম্য ইচ্ছা ও স্বামী ও সন্তানদের অনুপ্রেরণায় নবম শ্রেণি থেকে শুরু করি। ভর্তি হই ছোটখাতা ফাজিল মাদরাসায়। সে সময় মেয়েও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এরপর ২০২০ সালে মেয়ের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হই।
এই বয়সে এসেও কেন পড়াশোনা করতে চান জানতে চাইলে মারুফা বলেন, সমাজের আর দশটা মানুষের মতো আমিও একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে যেন নিজের পরিচয় দিতে পারি। এ জন্যই কষ্ট করে পড়াশোনাটা আবার শুরু করেছি। ইচ্ছে আছে এইচএসসি পাশ করে দেশের ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার।
মারুফা আক্তারের স্বামী সাইদুল ইসলাম বলেন, আমি তার ইচ্ছেটার মর্যাদা দিয়েছি। সে যতদূর পড়াশোনা করতে পারে, আমি চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করবো। তার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুল ইসলাম বলেন, মা-মেয়ের বিষয়টি আসলে অবাক হওয়ার মতো। বিষয়টি অনেকের অনুপ্রেরণা জাগাবে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষার কোনো বয়স নেই, চলো সবাই পড়তে যাই। এটা তার বাস্তব উদাহরণ। অদম্য এ মায়ের জন্য সবসময় দোয়া থাকবে, কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমাকে জানালে চেষ্টা করবো পাশে থাকার।