মানব পাচারের সহজ রুট কক্সবাজার

অনলাইন ডেস্ক :

কক্সবাজারের একটি শীর্ষ মানব পাচারকারী চক্রের নেতৃত্ব রয়েছে জেলা শহরের কৃষক লীগ নেতা একরামুল হক জুয়েল। চক্রটি ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও বাংলাদেশি নাগরিককে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এর সঙ্গে বিএনপি নেতা নুরু উদ্দিন, সুমন ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

টার্গেট রোহিঙ্গারা : প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল দিয়ে একের পর এক মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। জেলার ১২০ কিলোমিটার সাগর উপকূল সন্ধ্যার পর অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এ সময় বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচারের ঘটনা ঘটলেও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই। মূলত শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকার সুযোগে পাচারকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তাদের টার্গেটে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা। ছেলেদের চাকরি ও মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাচারের চেষ্টা করে দালালরা।

সোমবার মধ্যরাতে শতাধিক রোহিঙ্গা নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে টেকনাফে একটি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক শিশু ও পাঁচজন রোহিঙ্গা নারীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ আছেন ২৫ জন। এ ঘটনায় ২৪ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ৬ দালাল।

এ ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া উখিয়া ২৭নং ক্যাম্পের রহিমা খাতুন (১৭) জানায়, মূলত বিয়ে ও উন্নত জীবনের আশ্বাস পেয়ে তিনি অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিলেন। দালাল ট্রলারে তোলার আগে তাদের একটি পাহাড়ে নিয়ে ১১ দিন আটকে রাখে। একই তথ্য জানায়, ক্যাম্পের বাচা মিয়ার মেয়ে রুকেয়া বেগম (১৫)। সে বলে, মালয়েশিয়ায় বসবাস করা মামাতো ভাইকে বিয়ে করার জন্য মালেশিয়ায় যেতে চেয়েছিল।

বিষয়টি পরিবারের সবাই জানে। সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায় চুক্তি হয়ে দালালদের সঙ্গে। এ ছাড়া চলতি বছরের ২০ মার্চ চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া পাচারকালে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া উপকূল থেকে ১৪৭ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ৭৩ নারী, শিশু ২৩ ও পুরুষ ৫১ জন। এর আগে কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া ও টেকনাফ থেকে প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাচারের জন্য তাদের আনা হয়েছিল।

দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে : আদালত ও জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার বিভিন্ন থানা ও আদালতে ৬৫০টির বেশি মানব পাচারের মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামি এক হাজারের বেশি। এদের মাধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন গ্রেফতার হলেও বেশির ভাগ ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলায় বর্তমানে ১৩ থেকে ১৫টি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যেক চক্রে ১৫ থেকে ২৫ জন সদস্য রয়েছে। তবে কক্সবাজার শহরের আলোচিত কৃষক লীগের নেতা একরামুল হক জুয়েলের সিন্ডিকেট সব চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত চক্রটি আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে মাধ্যম হিসাবে কাজ করে থাকে জুয়েলের সিন্ডিকেট। তারা ২০১২ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫ থেকে ১০ হাজার মানুষ পাচার করেছে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে একরামুল হক জুয়েল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলা হয়েছে, আমি জেলও খেটেছি।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর দালাল হিসাবে কাজ করছে ১৬নং ক্যাম্পের মো. সায়ীদের ছেলে রোহিঙ্গা মো. রফিক (৩৪) ও বাদশা মিয়ার ছেলে হারুনের নেতৃত্ব অন্তত ৫০ জন।

জেলার বিভিন্ন থানায় করা মানব পাচার মামলা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দালাল হিসাবে টেকনাফের সাবরাং এলাকার আকতার কামাল, সাঈদ কামাল, মোয়াজ্জেম হোসেন; রামুর আব্দুল্লাহ বিদ্যুৎ, শহরের রাসেল, মহেশখালীর কালিমারছড়ার মোহাম্মদ হোসেন, শাহপরীর দ্বীপ মাঝরপাড়ার জায়েত উল্লাহ, সব্বির আহাম্মদ, সাজেদা বেগম, আব্দুল্লাহ, ইউনুচ, কলিম উল্লাহ, আব্দুস শুক্কুর, ঘোলাপাড়ার শামসুল আলম, কবির আহমদ, হাজীপাড়ার মুজিব উল্লাহসহ অন্তত ২৫০ জন রয়েছে। তাদের অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ ছাড়াও কক্সবাজারের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন জেলা থেকে মানব পাচারে জড়িত রয়েছে নরসিংদীর মো. শাহজালাল, নুর মোহাম্মদ প্রকাশ ইমরান, জিয়াউর রহমান, আবদুর রহমান; নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলাম, শহিদ উল্লাহ, আবদুস সাত্তার; চুয়াডাঙ্গার মো. আকিম, মো. কাশেম, আকিল উদ্দিন; সিরাজগঞ্জের সাত্তার মোল্লা, কুড়িগ্রামের মো. সালাম, সাতক্ষীরার আশরাফ মিয়া, বগুড়ার সাহাব উদ্দিন, যশোরের আবুল কালাম, মেহেরপুরের আহাম্মদ উল্লাসহ অন্তত ৩০০ জন।

পাচারের মামলার বিচার হয় না : কক্সবাজার আদালত সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে ৮টি থানায় ও ট্রাইব্যুনালে ৬৫০টির বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন মামলা ৩৩০টি, ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলা ৫৮টি এবং ট্রাইব্যুনাল-৩ এ বিচারাধীন ২৬০টি। বাকি ১৬টি মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের পর থেকে হওয়া এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের জন্য সহজ রুট হিসাবে কক্সবাজারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা ৫, ৬ বছর ধরে কক্সবাজার থেকে ট্রলারে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে অনেক ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে।

এতে অসংখ্য নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরপরও থামছে না মানব পাচার। তিনি বলেন, মানব পাচার বন্ধ না হওয়ার বড় কারণ হলো-গত ৭-৮ বছরের মধ্যে যেসব মামলা হয়েছে তার কোনোটির বিচার কাজ শেষ না হওয়া। অর্থাৎ সমাজে এমন কোনো বার্তা দেওয়া যায়নি, যে কারণে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতরা ভয় পাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমদিকে কিছুটা তৎপরতা দেখালেও আসামি গ্রেফতার, মামলার চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। এর ফাঁকফোকরে আসামিরা এক ধরনের রেহাই পেয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, মানব পাচার বন্ধ করতে হলে অবশ্যই সব মামলার সুস্থ ও দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করতে হবে। জড়িতদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে।

মামলারও বিচার কাজ শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে কক্সবাজার আদালতের পিপি ফরিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, মানব পাচার জঘন্য একটি অপরাধ। জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু বিচারক সংকট ও নানা কারণে এখন পর্যন্ত একটি মামলার বিচারও শেষ করতে পারিনি আমরা। তবে আদালত মানব পাচার মামলাগুলো দ্রুত বিচার শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আসামি ধরা না পড়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এখন থেকে আর কেউ ছাড়া পাবে না। মানব পাচারের সব মামলা পর্যালোচনা করে আসামিদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জড়িতরা যেখানেই থাকুক, তাদের খুঁজে বের করা হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)