ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তিপূর্ণ বিশ্ব রেখে যেতে চাই

নিউজ ডেস্ক:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করা, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান, যুদ্ধ বন্ধ করা, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করাসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছেন তিনি। এছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তিপূর্ণ বিশ্ব রেখে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

শুক্রবার বিকেলে (বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোররাতে) এ ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরো ভাষণ তুলে ধরা হলো-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মাননীয় সভাপতি, আসসালামু আলাইকুম এবং শুভ অপরাহ্ন।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আশ্বাস দিচ্ছি, সাধারণ পরিষদের পুরো অধিবেশন জুড়েই আমার প্রতিনিধি দল আপনাকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিয়ে যাবে। একই সঙ্গে আপনার পূর্বসূরি জনাব আবদুল্লাহ শহীদকেও অভিনন্দন জানাই। জাতিসংঘ মহাসচিব জনাব আন্তোনিও গুতেরেসকে আমি সাধুবাদ জানাই জাতিসংঘকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরো প্রাণবন্ত করে তোলার লক্ষ্যে তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতির জন্য।

এ বছরের সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য: ‘একটি সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণ: আন্তঃসংযুক্ত প্রতিকূলতাসমূহের রূপান্তরমূলক সমাধান।’ জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা ও সংঘাত, কোভিড-১৯ মহামারির মতো একাধিক জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রতিকূলতায় পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহ আজ জর্জরিত। এবারের প্রতিপাদ্যটি এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলায় এবং আমাদের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য সবার ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এখনি সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।

জনাব সভাপতি,
গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের মহামারির মারাত্মক প্রভাব বিশ্ব যখন সামলে উঠতে শুরু করেছে, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বকে নতুন করে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জ্বালানি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়তা-প্রার্থী ঝঁকিপূর্ণ দেশগুলো এখন আরো প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। বর্তমানে আমরা এমন একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছি, যখন অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করা আবশ্যক।

আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে, সংকটের মুহূর্তে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো জাতিসংঘ। তাই, সর্বস্তরের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য জাতিসংঘকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সবার প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে হবে।

যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মত বৈরীপন্থা কখনো কোনো জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাই সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ’ গঠন করায় জাতিসংঘের মহাসচিবকে আমি ধন্যবাদ জানাই। এই গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, আমি বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব ও সংকটের গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বৈশ্বিক সমাধান নিরূপণ করতে অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।

জনাব সভাপতি,
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত পররাষ্ট্র নীতির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়”। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিপাদ্য-উদ্ভূত জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছে। ১৯৭৪ সালের ২৫-এ সেপ্টেম্বর এই মহান পরিষদে তিনি তার প্রথম ভাষণে বলেছিলেন: “শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারবো এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো। সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেই সকল প্রচেষ্টাকে, যার লক্ষ্য বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করা, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতি জোরদার করা।

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্য এখনো সমভাবে প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বাস করতেন যে, শান্তি হলো বিশ্বের সব নারী-পুরুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিরূপ। যুদ্ধের ফলে মানবজাতি, বিশেষ করে শিশু ও নারীরা চরম কষ্ট ভোগ করে। কত মানুষ রিফিউজি হয়ে পড়ে।

সভাপতি মহোদয়,
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে এ সংকট মোকাবিলায় আমরা মূলত তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছি। প্রথমত, মহামারি সংক্রমণ ও বিস্তাররোধ করতে আমরা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে কৌশলগত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেছি। তৃতীয়ত, আমরা জনগণের জীবিকা সুরক্ষিত রেখেছি। এসব উদ্যোগ মহামারিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করেছে।

মহামারি থেকে আমাদের নিরাপদ উত্তরণের মূল চাবিকাঠি হলো টিকা। এই টিকা সরবরাহের জন্য আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এর কোভ্যাক্স ব্যবস্থা এবং আমাদের সহযোগী দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানাই। ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত, বাংলাদেশে টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে আমরা টিকা দিয়েছি।

জনাব সভাপতি,
একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসেবে আমাদের অবস্থান ৪১তম। বিগত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পূর্বে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৫ শতাংশ। এর আগে, আমরা টানা তিন বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। মহামারি চলাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬.৯৪ শতাংশ হারে প্রসারিত হয়েছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের মতো অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মুল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার জন্য এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু-সহিষ্ণু বদ্বীপে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

সভাপতি মহোদয়,
সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, মা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত এক দশকে সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছি।

আমাদের শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ২১ জন এবং প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃ মৃত্যুহার ১৭৩ জনে নেমে এসেছে। মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছরের অধিক।

আমরা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ মনযোগ দিয়েছি যেন সমাজের কেউ পিছিয়ে না থাকে। স্বামী-পরিত্যাক্তা নারী, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গ এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকৃত হচ্ছেন।

উন্নত ভৌত অবকাঠামো মজবুত অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এজন্য আমরা নদীর তলদেশের টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেমসহ টেকসই বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ করছি। আমাদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত “পদ্মা বহুমুখী সেতু”। এটি বাংলাদেশের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করবে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে। এই সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১.২৩ শতাংশ হারে অবদান রাখবে।

জনাব সভাপতি,
মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব। জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি থাকাকালে আমরা ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রস্পারিটি প্লান’ গ্রহণ করি। যার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে “ঝুঁকির পথ থেকে জলবায়ু সহনশীলতা ও জলবায়ু সমৃদ্ধির টেকসই পথের” দিকে নিয়ে যাওয়া।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা এবং নীতিগুলো জেন্ডার সংবেদনশীল করে তৈরি করা হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানাই।

সভাপতি মহোদয়,
অভিবাসীরা এখনো তাদের অভিবাসন যাত্রায় অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব এবং সংহতি বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন এবং এর “অগ্রগতি ঘোষণা” আমাদের এ বিষয়ে একটি চমৎকার রোডম্যাপ দিয়েছে।

বর্তমানে এসব জটিল বৈশ্বিক সংকট অনেক উন্নয়নশীল দেশের বিগত কয়েক দশকের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে স্থবির করে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে ২০৩০-এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা তাদের অনেকের কাছেই একটি অধরা স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং কৃষিসহ মারাত্মভাবে প্রভাবিত ক্ষেত্রগুলোতে সুনির্দিষ্ট সহায়তা প্রয়োজন। এখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

আমরা দেখছি, কিভাবে নিত্যনতুন প্রযুক্তি বিশ্বকে দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের সবার ন্যায্য এবং সমান সুযোগ পাওয়া অপরিহার্য। ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত বিভাজন অবশ্যই দূর করতে হবে।

বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার পথে। তবে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সংকট আমাদের টেকসই উত্তরণের পথে গুরুতর প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছে। আমাদের উন্নয়নের অংশীজনদের কাছে বর্ধিত এবং কার্যকর সহযোগিতার আহ্বান জানাই। এ বিষয়ে দোহা কর্মসূচিকে আমরা স্বাগত জানাই।

জনাব সভাপতি,
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির পর সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বব্যাপী অংশীজনদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করি।

সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘের কনভেনশনের বিধানগুলির কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এ বিষয়ে যেকোনো দুর্বলতা উত্তরণের জন্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার এবং জাতীয় এখতিয়ারের বাইরের অঞ্চলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক আইন যা “বি বি এন জে” নামে পরিচিত, সেটি প্রণয়নে আরো তৎপর হওয়ার জন্য সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানাই।

সভাপতি মহোদয়,
পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধসহ সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ২০১৯ সালে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক ঐতিহাসিক চুক্তি অনুস্বাক্ষর করি।

আমরা ধারাবাহিকভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে আসছি। আমাদের শান্তিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্য ও পুলিশ প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে আমরা বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছি।

শান্তিরক্ষাসহ, জাতীয় ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান, নারী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি টেকসই সমাজ গঠন করতে এসব অঞ্চলের জনগণকে তারা সাহায্য করে যাচ্ছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের অনেক শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন।

আমরা বিশ্বাস করি যে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল কারণগুলোর সমাধান ব্যতিত টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ শান্তি বিনির্মাণ কমিশনের বর্তমান সভাপতি হিসেবে আমরা সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে বহুমাত্রিক অংশীজনদের একসঙ্গে কাজ করার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। নারী, শিশু, শান্তি ও নিরাপত্তা এজেন্ডাকে আরো শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে আমরা ‘শূণ্য সহনশীলতা’ নীতি গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোনোরূপ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা জনগণের ক্ষতি হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দেই না। এছাড়া সাইবার-অপরাধ এবং সাইবার সহিংসতা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়ণে একসঙ্গে কাজ করার জন্য আমি সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানাই।

জনাব সভাপতি,
একটি দায়িত্বশীল সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা একটি সামগ্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পন্থা অবলম্বন করেছি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় অধিকার ও কল্যাণ সাধনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনি বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছি। দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য বিনামূল্যে আবাসন প্রদানের লক্ষ্যে ‘আশ্রয়ণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করছি। ১৯৯৭ সাল থেকে আমার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বিগত ১৮ বছরে প্রায় ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সভাপতি মহোদয়,
অধিকৃত ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমান্তের ভিত্তিতে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান ও রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকে নির্ধারণ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি বাংলাদেশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি।

জনাব সভাপতি,
আমি এখন আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দিকে। গত মাসে ২০১৭ সালে স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরো দুরূহ করে তুলেছে। আশা করি, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে। এ সংকট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

জনাব সভাপতি,
কোভিড-১৯ মহামারি থেকে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়’। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘসহ আমাদের অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাস্তবিক ও অত্যাবশ্যক সংস্কার করা উচিত যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য আরো কার্যকর প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়।

আমরা দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং আর্থিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের মতো বৈশ্বিক প্রতিকূলতাগুলোর রূপান্তরমূলক সমাধান খুঁজতে আগ্রহী। তবে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ব্যতিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সব মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, শিশুরাই বেশি কষ্ট ভোগ করে। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।

আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব- যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরো সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।

জনাব সভাপতি,
এখন আমি এক নিদারুণ ট্রাজেডির কথা বলবো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে আমার মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, আমার ছোট তিন ভাই- বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তার স্ত্রী পারভিন রোজী, আমার ১০ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

আমার চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ফুফা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার কন্যা ১৩ বছরের বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের আরিফ সেরনিয়াবাত এবং ৪ বছরের সুকান্ত, আমার ফুফাত ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ব্রিগেডিয়ার জামিল, পুলিশ অফিসার সিদ্দিকুর রহমানসহ ঘাতকরা ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জার্মানিতে ছিলাম বলে আমার ছোটবোন শেখ রেহানা ও আমি বেঁচে যাই। ৬ বছর রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। দুই লাখ মা-বোনের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

১৯৭১ সালে আমার পিতাকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় আমার মা, দুই ছোটভাই শেখ রাসেল ও শেখ জামাল, ছোটবোন শেখ রেহানা ও আমাকে গ্রেফতার করে একটি একতলা স্যাতসেতে বাড়িতে রাখে। আমার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ঐ বন্দিখানায় জন্মগ্রহণ করে। আমাদের ঘরে কোনো ফার্নিচার দেওয়া হয়নি। সুচিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দৈনন্দিন খাবার পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত।

কাজেই যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই। আমার আকুল আবেদন, যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই।

সবাইকে ধন্যবাদ।

খোদা হাফেজ।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)