ব্যহত হচ্ছে সরকারি উদ্যোগ  কালিগঞ্জে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বেহাল-দশা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ৭০টি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা হ-য-ব-র-ল। বিদ্যালয়ের মেঝেতে কার্পেট , শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম, মাসিক ১২০ টাকা উপবৃত্তি, টিফিনসহ ১৬টি ধরণের বরাদ্দ খাকলেও কেবলমাত্র খাতা বাই ও পেনসিল নিয়ে খুশী থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর আগেই দেওয়ার বিধান থাকলেও দেওয়া হচ্ছে আট মাস পর। বিদ্যালয়ের মাসিক ভাড়া ও শিক্ষার্থীদের বেতন নৈব নৈব চ। বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা চলমান হাল হকিকত সম্পর্কে অবহিত নন।

সাতক্ষীরা জেলা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের এডিপি’র অর্থায়নে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ১১ থেকে ৪৫ বছরের মহিলা ও পুরুষের জন্য ‘মানব উন্নয়নের জন্য সাক্ষরতা উত্তর ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-৪ কার্যক্রম’ বাস্তবায়নে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) অনুমতি পায়। ৪ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয়েছে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে। ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে ৪২ মাসের প্রকল্প শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের ২২ মাস পরে।

সূত্রটি আরো জানায়,কালিগঞ্জ উপজেলায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বিদ্যালয় পিছু ৩০ জনের বিপরীতে ৭০টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয় ভবন ভাড়ার জন্য ভ্যাটসহ এক হাজার ৫০০ টাকা মাসিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদের মাসিক উপবৃত্তি বাবদ তাদের অভিভাবকদের বিকাশ নাম্বারে ১২০ টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিদ্যালয় শুরুর আগেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদ্যালয় শুরুতেই শিক্ষার্থীদের ইউনিফরম, ব্যাগ, টিফিন, মেঝেতে কার্পেট, শিক্ষকদের মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনসহ ১৬ প্রকারের বরাদ্দ উলে­খ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৪২ মাসে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ভ্যাটসহ চার কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ ছাড়া কোন শিক্ষার্থী কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় পড়াশুনা চলমান থাকলেও তাকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা যাবে না।

সরেজমিনে বৃহষ্পতিবার ও শনিবার সকাল থেকে কালিগঞ্জের মৌতলা কাজীপাড়া, কৃষ্ণনগর গাজীপাড়া, বিষ্ণুপুরের পানঘাট জেলেপাড়া, বিষ্ণুপুর, চাচাই, থালনা, চাদখালি, পূর্ব নলতা, থালনা, চম্পাফুল, পূর্ব নলতাসহ কয়েকটি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সরকারি নিয়মের ব্যত্তয় ঘটিয়ে কার্যক্রম চলছে। কোথাও মেঝেতে কার্পেট নেই। কয়েকটিতে জমি দাতার বাড়িতে বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে বললেও ভয়ে শিক্ষার্থীরা গৃহকর্তার শৌচাগার ব্যবহার না করে রাস্তার ধারে কাজ সারতে বাধ্য হয়। শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের বই, খাতা ও পেনসিল দেওয়া হলেও কোথাও কোথাও তা পর্যাপ্ত নয়। ব্লাক বোর্ডে ব্যবহৃত চখ ব্যবহার অনুপযোগী।

তবে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার পাশাপাশি জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এসেম্বেলি করানো হয় বলে জানালেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কোনদিনও টিফিন, ইউনিফরম, স্কুল ব্যাগ ও উপবৃত্তির টাকা না পেলেও প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষাথী ক্লাসেন আসে। তবে আগে থেকে প্রস্তুত করে দেওয়ায় অনেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বা মাদ্রাসায় পড়লেও সাংবাদিকদের সঙ্গে এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি অনেকে। তবে মোবাইল ফোনে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং অনেকেই সরাসরি সরকারি প্রাথমিক বিদালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রসায় পড়েও উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসেন বলে জানান। এতে তারা উপকৃত হচ্ছেন বলেও জানায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

মৌতলা কাজীপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যায়ের শিক্ষার্থী ঝড়–খামার গ্রামের হাফিজুল ইসলামের ১৪ বছর বয়সী ছেলে ্সমাইল হোসেন জানায়, সে এক সময় নমাজগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তো। ১০১৮ সালে সে মৌতলা ছিদ্দিকিয়া এতিমখানায় হেফজো পড়তো। কয়েক মাস যাবৎ সে এ বিদ্যালয়ে পড়ছে। কাজী স্বাদ মৌতলা এতিমখানায় পড়ে। আব্দুর রহমান, আজনিন সুলতানা, আশরাফুল ইসলাম, অলি, মোঃ শাহীনসহ অনেকেই স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। তবে এখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে ৬ জন। আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজনের বয়স সাড়ে ৫ থেকে ছয় বছর। যাদের এ বিদ্যালয়ে গত ডিসেম্বরে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করার সরকারি কোন বিধান ছিল না। জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষিকা তাজিয়া সুলতানা বলেন, এখানে কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নেই। তবে মাদ্রাসায় অনেকে পড়াশুনা করতো। সবমিলিয়ে সামান্য ত্র“টি বিচ্যুতি থাকলেও হাজিরা প্রায় শতভাগ। তবে নিজের বেতন ও বিদ্যালয় ভবনের ভাড়া যথারীতি পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।

কৃষ্ণনগর গাজীপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক দীপালী রানী ঘোষ বলেন, প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ২৭ জন শিক্ষার্থ ক্লাসে আসে। শুধু বই, খাতা ও পেনসিল শুরু থেকেই দেওয়া হয়। গত রোববার ১২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এ কদিন স্কুল করা হয়নি। সুপ্রিয়া ঘোষসহ তিনজন প্রতিবন্ধি রয়েছে তার বিদ্যালয়ে। নিজের উদ্যোগেই তাদেরকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন। বাড়ি বাড়ি যান শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াতে। এ সময় প্রকল্পের উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তাফিজ কামাল বলেন, বরাদ্দকৃত টাকা ছাড় না হওয়ায় উপবৃত্তি, স্কুলের ব্যাগ, ইউনিফর্ম , টিফিনসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা হুমকির মুখে। এরপরও তিনি বলেন এ প্রকল্পে তারা শতভাগ সফল হবেন।

বন্দকাটি পানঘাট জেলেপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝর্ণা রানী কর্মকার বলেন, পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ বন্দ;কাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লাকী কোমরপুর সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার পরও করোনাকালিন ঝরে পড়া অনেক শিশুই এ বিদ্যালয়ে পড়ে। পানঘাটের ১৪ বছর বয়সী প্রদীপ মণ্ডল, গোবিনদ মণ্ডলসহ অনেকেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না পড়ার কথা বললেও তাদের অবিভাবকদের সাথে মোবাইলে কথা বলে জানা গেছে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য অনেকাংশেই সত্য নয়।

চাদখালি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মিরিনা পারভিন বর্তমানে নলতায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তবে শিক্ষার্থী সুমাইয়া, নাঈমুর রহমান রিয়াদ, নোমান, তাসপ্রিয়া, আল মামুন, ফাহিমসহ কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থী জানায়, তারা চাদখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার পাশাপাশি এ বিদ্যালয়ে পড়ে। শারমিন পঞ্চম শ্রেণীতে, রুমি, মিথিলা, আছিয়া ও মাজিয়া চাদখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। তবে হাসি জানায় সে কেবলমাত্র শিরিনা ম্যাডামের স্কুলে পড়ে।

পূর্ব নলতা উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকা শরিফা খাতুন প্রশিক্ষণে থাকলেও লুবাইয়া তাবাসুম, মুনতাহা, মুনতাহা পাড় সহ কয়েকজন পড়ে আল হেরা প্রি ক্যাডেট মাদ্রাসায়। ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ জনের বেশি পড়ে পূর্ব নলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্রালয় বা আস্কারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ প্রতিষ্ঠানে খাতা, পনেসিল ও বই তাদের সম্বল।

তবে চম্পাফুল কালীবাড়ি, ঘুষুড়ি, থালনা দক্ষিণ বন্দকাটি, বিষ্ণুপুর, চাচাই, ইন্দ্রনগর, মৌতলা কাজীপাড়া, পানিয়া গাজীপাড়াসহ অধিকাংশ বিদ্যালয়ে নীতিমালা বহির্ভুতভাবে কার্যক্রম চলছে। তদারকির দায়িত্বে থাকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ শুধু তড়িঘড়ি করে নামমাত্র কয়েকটি স্কুল ঘুরে সাত দিনের মধ্যে ৭০টি শিক্সা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দায়সারা একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন বলে অভিযোগ সচেতন মহলের। এর সঙ্গে রয়েছে প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তাফিজুর কামাল। তিনি সুকৌশলে ব্যর্থতা ঢেকে শতভাগ সফলতার গান গেয়ে যাচ্ছেন।

তবে স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ , সমগ্র সাতক্ষীরা জেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থী মাত্র এক হাজার ৩০০ জন থাকলেও কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার। দুই হাজার ১০০ জন শিক্ষার্থীদের অর্ধেকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসার চলমান শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ২০ শতাংেশের বেশি রয়েছে শিশু, যাদের ভর্তির বয়স হয়নি। যেভাবে প্রকল্প চলছে তাতে বরাদ্দের অধিকাংশ টাকাই সাস ও তাদের অংশীদার এনজিওদের পকেটে যাবে।সব মিলিয়ে সরকারের ২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকার শিক্ষা প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্যে ভেস্তে যেতে বসেছে।

তবে নয় মাস ক্লাস করেও দুই থেকে তিন মাসের বেতন পাওয়ার কথা জানিয়ে তাদের নাম প্রকাশ না করার আবেদন জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষক।
কালিগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তাকে ৭০টি স্কুলের প্রতিবেদন এক সপ্তাহে দিতে বলা হয়। তিনি নামমাত্র কয়েকটি স্কুল ঘুরে সামগ্রিক প্রতিবেদন দিয়েছিলন। সময় পান না তাই কোন স্কুলে যাওয়া হয় না। তবে বরাদ্দের ১৬ টির মধ্যে ১০টিতে অনিয়ম আছে স্বীকার করে তিনি বলেন তিনি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলবেন।

এনভাইরনমেন্ট এণ্ড এগ্রিকালচারাল ডেভলপমেন্ট এ্যসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, তিনি সাস এর সঙ্গে অংশীদার হিসেবে কাজ করছেন। টাকার অভাবে শুরুতেই বিভিন্ন বিষয়ে অনিয়ম থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা কাটিয়ে ওঠা যাবে। তবে ৪২ মাসের শিক্ষা কার্যক্রম ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করানাকালিন পরিস্থিতিতে শুরু করতে হয়েছে ডিসেম্বরে। ২০২৩ এর জুন মাসে কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগামিতে আরো দুই বছর মেয়াদ না বাড়ালে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সফল হবে না।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)