দীর্ঘ লড়ায়ের পর ১৮ দিনের এসিডদগ্ধ সোনালী এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে
নিজস্ব প্রতিনিধি:
সোনালি খাতুন (১৯)। মাত্র ১৮ দিন বয়সে মা-বাবার সাথে এসিড আক্রান্তহয়েছিল ছোট্ট শিশু সোনালী। ১৮ দিনের শিশু সোনালী মা-বাবার কোলের মধ্যে
ঘুমিয়ে ছিল রাতে। দূর্বৃত্তরা রাতে অন্ধকারে এসিড ছোড়ে সোনালীর মা ও বাবার শরীরে পিতা-মাতার সাথে এতটুকুন শিশু সোনালীর মুখ, শরীর ঝলসে যায়
সেদিন। রাতে। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে সোনালী ও তার বাবা-মা এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়। ২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর রাতে ঘটে সোনালীর পুরো পরিবারের উপর এসিড আক্রমণ। সে দিনের সেই ছোট্ট সোনালী পাটকেলঘাটা থানার কুমিরা পাইলট গার্লস হাইস্কুল থেকে এবার (২০২২ সাল) উচ্চ মাধ্যমিক (এসএস)সি পরীক্ষা দিচ্ছে। সোনালী সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার নকাটি গ্রামের নুর ইসলাম খোদেজা দম্পতির সন্তান।
সোনালির বাবা নুর ইসলামের বাবা এবং চাচা দুই ভাই। নুর ইসামামের চাচার জমির বাঁশঝাঁড় প্রতিবেশির জমিতে পড়া এবং সেই বাঁশ কাটাকে কেন্দ্র করে
গোলোযোগের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ওই বাঁশ কাটাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিরোধে থানায় মামলা হয়। মামলা করার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার দিন রাত আনুমানিক ১২টার দিকে দূর্বৃৃত্তরা সোনালী ও তার বাবা-মাকে এসিড নিক্ষেপ করে। এতে তার চোখ-মুখ, মাথা ও ঘাড় ঝলসে যায়, পুড়ে শরীরের একটি বড় অংশ। সোনালীর জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর দিনে তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ দিন। তার শরীরের ক্ষত স্থান এখনও চুলকায় ও চোখ দিয়ে পানি ঝরে। সোনালি বর্তমানে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
রাত ১২টায় এসিড আক্রান্ত হওয়ার পর বাবা-মার সাথে সোনালীকে প্রথমে স্থানীয় মির্জাপুর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে তাদেরকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা হয়। সোনালীকে ঢাকায় এক বছর উন্নত চিকিৎসার আওতায় আনা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। মামলার আসামিরা দীর্ঘদিন জেল খাটে। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
সোনালি খাতুনকে স্থানীয় এনজিও স্বদেশ’র সহযোগিতায় একশনএইড বাংলাদেশ’র প্রিভেনশন অব এসিড ভায়োলেন্স প্রকল্পের আওতায় তার পরিবারকে আত্মবিশ্বাস গঠনমূলক কর্মশালার অর্ন্তভুক্ত করে সহযোগিতা করা হয়। একশনএইড বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সোনালী পড়ালেখার সহযোগিতা বাবদ উপবৃত্তি পেয়ে আসছে। স্বদেশ’র সহযোগিতায় প্রথম আলোর মাধ্যমে সোনালির নামে দশ শতক জমি বন্ধক করে দেওয়া হয়েছে। জেলা এসিড কন্ট্রোল কমিটি থেকে সহযোগিতা পেয়েছে। একশনএইড বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় তার পড়ালেখায় আর্থিক
সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।
সোনালীর এই পর্যন্ত টিকে থাকা ও পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া খুব সহজ ছিল না। স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার পর সোনালীকে স্কুলে ভর্তি করার পর স্কুলের
অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। প্রথম দিকে তাকেস্কুলে যেতে নানারকম সামাজিক বাঁধার সম্মুখি হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে
একশনএইড বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় স্বদেশ স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে শিক্ষক,
শিক্ষার্থী, সমাজের সাধারণ মানুষেকে কাউন্সেলিং, সামাজিক সম্পৃক্ততা করে সোনালীর স্কুলে পড়ালেখা অব্যাহত রাখার প্রয়াস চালানোর ফলে সোনালীর শিক্ষা জীবনের মাধ্যমিক স্তর সফলতার সাথে সমাপ্তের পথ সুগম হয়েছে। সোনালী স্বপ্ন দেখছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। তার দরকার আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতা।
পরীক্ষা শুরুর আগে কথা হয় সোনালীর সাথে এই প্রতিবেদকের। সোনালী খাতুন জানায়, সে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরে খুশি। সে স্বপ্ন দেখে
আগামীতে সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের মূল ¯্রােতে ফিরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অন্যদেরকে সহযোগিতা করবে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে যাতে তার পথ সুগম হয় সেজন্য সে সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে।
সোনালীর বাবা নুর ইসলাম ও মা খোদেজা খাতুন জানান, ১৮ দিন বয়সের আমাদের ছোট্ট সোনালী আজ একশনএইড বাংলাদেশ, স্বদেশ ও সেতুবন্ধন গড়ি নেটওয়ার্কের (এসবিজিএন) সহযোগিতায় তার পড়ালেখা চালাতে পেরেছে। তারা বলেন, ‘এজন্য আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে তার শিক্ষক ও সকল সংগঠনকে বিশেষ করে স্বদেশের নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত, একশনএইড বাংলাদেশ নুরুন নাহার এবংতার সকল শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই’।
কুমিরা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিক্ষক গৌতম কুমার দাশ জানান, সোনালী সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে আজ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে যাওয়ার পর্যায় এসেছে। এজন্য ওর অদম্য মানসিক সাহজ ও সকলের সহযোগিতা ওকে এতো দূর আসতে সাহায্য করেছে। আমাদের পক্ষ থেকে সোনালীকে অভিনন্দন। সোনালীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায় থেকেক সহযোগিতা করা জরুরি। আমাদের স্কুলের সোনালী এ পর্যন্ত সুনামের সাথে লেখাপড়া করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।
আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে ওকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি। আগামীতে সোনালীর জন্য আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। মানবাধিকার কর্মী ও স্বদেশ’র নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, একশনএইড বাংলাদেশ, স্বদেশ ও সেতুবন্ধন গড়ি নেটওয়ার্কের (এসবিজিএন) এবংদেশ-বিদেশের যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন এসিড সারভাইভার সোনালীকে এই পর্যন্তআসতে সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি স্বদেশ’র পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা। সোনালীর
উচ্চ শিক্ষালাভে স্বদেশ সবসময় পাথে থাকবে।