মৌসুমি জ্বরের উপসর্গ ও চিকিৎসা

অনলাইন ডেস্ক :

সময়টাই শর্দি জ্বরের। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ঘরে ঘরে জ্বর জারি লেগেই আছে। মৌসুমি জ্বরে খাবার খাওয়ার রুচি কমে আসে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই আতঙ্কে থাকেন জ্বর আক্রমণাত্বক দিকে মোড় নেয় কিনা।

মৌসুমি জ্বরের উপসর্গ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন।

লক্ষণ
জুলাই মাস থেকে আমাদের দেশে কারও স্বল্প দিনের জ্বর হলে ডেঙ্গু ভাবতে কোনো দোষ নেই। এ জ্বর সাধারণত ৭-৮ দিন থাকে। প্রথম দিকে ব্যথা, গা ম্যাজ-ম্যাজ করলেও মাথাব্যথাই প্রকৃত উপসর্গ। যে কোনো জ্বরের মতো ক্ষুধামন্দা, বমি ভাব, নাক ঝরা, চোখ লালচে হতে পারে তবে বিশেষত্ব হল সারা শরীরে ব্যথা। ব্যথা এত বেশি যে অনেকে একে ‘ব্রেক বোন ডিজিজ’ বলে। চোখ নড়ালে ব্যথা অনুভব অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কফ কাশি, গলায় ব্যথা থাকতে পারে তবে এটি ডেঙ্গু জ্বরের বিশেষত্ব নয়। দুর্বল লাগা, গ্লান্ড ফোলা কারও কারও হয় তবে এর তীব্রতা সামান্য।

জ্বর : অন্য জ্বরের মতোই তবে বিশেষত্ব হল দুই দফায় জ্বর হয়। ৩-৪ দিন পর ২ দিন বিরতি দিয়ে আবার দু’দিন জ্বর। জ্বরের সঙ্গে পাল্স রেট কমাও বিশেষত্ব; অনেকের বেশ কিছুদিন অবসাদ থাকে।

র‌্যাশ : নিশ্চিতভাবে ডেঙ্গু জ্বর বুঝার উপায় কনফ্লুয়েন্ট কনভাল্সেন্ট র‌্যাশ। এটা উঠে ৬ষ্ঠ দিনে। আগে শরীরে হয় পরে বাহু ও অন্য জায়গায় ছড়ায়। হাতের পায়ের তালুতে হয় না। স্কারলেট ফিভার (২য় দিন) হামের মতো (৪র্থ দিন) র‌্যাশও হতে পারে।

রক্তক্ষরণ : জ্বর, র‌্যাশ, রক্তক্ষরণ ডেঙ্গুর বিশেষত্ব। যে কোনো জায়গা (নাক, চোখ, ত্বক, খাদ্যনালি মূত্র নালি) থেকে হতে পারে। মেয়েদের বেশি হয়, মাসিক হয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার মাসিক হয়। মনে রাখতে হবে রক্তক্ষরণ মানেই কিন্তু ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার নয়।

জটিলতা : ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম, রক্তনালিতে সর্বত্র রক্তক্ষরণ (ডিআইসি), সব অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি (মাল্টি অরগান ফেইলর)।

ডেঙ্গু ফিভার হওয়ার সম্ভাব্য স্থান

ডেঙ্গু হয় এমন এলাকায় থাকলে এবং জ্বর হলে তার সঙ্গে যদি নিম্নের যে কোনো দুটি যেমন বমি বা বমি বমি ভাব, র‌্যাশ, ব্যথা বেদনা, পজিটিভ টুরনিকেট টেস্ট, লিউকপেনিয়া হলে তা ওয়ারনিং সাইন।

এদের ল্যাবরেটরি টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। চিকিৎসা হল পর্যবেক্ষণে রাখা, ওয়ার্নিং সাইন সম্পর্কে সতর্ক থাকা। অন্য কোনো বড় অসুখ বা প্রেগনেন্সি না থাকলে ভর্তির দরকার নেই।

ডেঙ্গুর সতর্ক সংকেত

ডেঙ্গুর আশঙ্কাসহ যদি নিম্নলিখিত যে কোনো একটি থাকে যেমন- পেটে ব্যথা, পেট শক্ত হওয়া, অনবরত বমি, প্লুরাল ইফুশন বা এসাইটিস, রক্তক্ষরণ, লিভার এক ইঞ্চির বেশি বড়, হিমাটক্রিট দ্রুত বাড়া বা প্লাটিলেট দ্রুত কমা। এটা গ্রেড-২ ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার। ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা লাগবে, ওপিডি বা ইনডোরে নিতে হবে, স্যালাইন দিতে হবে, ভর্তির পরামর্শ দিতে হবে।

মারাত্মক ডেঙ্গু : মারাত্মক প্লাসমা লিকেজের ফলে শক (ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম), প্লুরাল ইফুশন হয়ে শ্বাসকষ্ট।

মারাত্মক রক্তক্ষরণ : খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ (হেমাটেমেসিস, মেলেনা)।

মারাত্মক অরগান ইনভলভ (atypical features)

লিভার : AST or ALT >˄ 1000

স্নায়ুতন্ত্র : খিচুনি, জ্ঞান লোপ পাওয়া।

হার্ট ও রক্তনালি : কার্ডিওমায়োপ্যাথি, হার্ট ব্লক, এরিথমিয়া।

অন্যান্য : কিডনি ফেইলর, প্যানক্রিয়াটাইটিস, এআরডিস (ফুসফুস অকেজো হওয়া), সর্বাঙ্গে রক্তক্ষরণ ও জমাট বাঁধা (ডিআইসি), মাংসপেশি ছিঁড়ে ছুটে যাওয়া (রাব্ডোমায়োলাইসিস)।

ডেঙ্গু ভাইরাল ফিভার, ক্লাসিক্যাল হলে সর্দিজ্বরের মতই সহজতর অসুখ। তা না হলে মারাত্মক। ওয়ার্নিং সাইন (তীব্রতার উপসর্গ)গুলো খেয়াল রাখতে হবে অর্থাৎ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : সব জ্বরের মতই তিন বা চার দিনের দিন টিসি, ডিসি, ইএস আর, প্লাটিলেট কাউন্ট করতে হবে। টিসি (টোটাল কাউন্ট) পাঁচ হাজারের নিচে কমে যাওয়া ডেঙ্গুর বিশেষত্ব। প্লাটিলেট কাউন্ট (স্বাভাবিক ১৫০০০০ থেকে ৪৫০০০০) প্রায় সব জ্বরেই কমে, এক লাখের চেয়ে কম হলে সেটা ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার, সেক্ষেত্রে সতর্কতা নিতে হবে ও ফলোআপ করতে হবে। এসজিপিটি, এসজিওটি লিভার ক্ষতের আলামত দেয়, ডেঙ্গুতে ওটি বেশি বাড়ে। এনএস-১ এ্যান্টিজেন ডেঙ্গুর পরীক্ষা তবে এর চেয়ে এলাইজা বেশি নির্ভরযোগ্য। ওয়ার্নিং সাইন বা মারাত্মক কোনো উপসর্গ থাকলে অন্যান্য পরীক্ষা করতে হবে।

চিকিৎসা : জ্বর নামানোর জন্য প্যারাসিটামল এবং প্রয়োজনীয় পানি পান করতে হবে। এ দুটোই মূলত ডেঙ্গুর চিকিৎসা। ডেঙ্গু ভীতি ওভারকাম করা জরুরি।

অন্য জ্বর থেকে পার্থক্য হল জ্বর চলে যাওয়ার ২দিন পর পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়, এই দুদিন হল ক্রিটিক্যাল সময় কারণ এ সময় মারাত্মক জটিলতা হয়। প্রথমদিকে বেশি পানি পান উপকারী হলেও এ সময়ে মিতব্যয়ী হতে হবে। বেশি পান করলে পেটে (এসাইটিস), ফুসফুসে (ইফুশন) পানি জমবে। ২৪ ঘণ্টায় ২ লিটার পানি হলেই চলে। তবে প্রস্রাবের পরিমাণ ও ব্লাড প্রেশার দেখে পরিমাণ নির্ধারণ করা ভালো। পাল্স প্রেশার ২০ এর বেশি রাখতে হবে।

রক্তক্ষরণ হলে যদি ব্লাড প্রেশার কমে (সিস্টলিক ১০০এর নিচে), পাল্স বাড়ে (রেট ১০০ এর বেশি) হিমোগ্লোবিন কমে (১০ এর কম, হিমাটক্রিট কম) রক্ত (ব্লাড ফর ব্লাড) দিতে হবে।

ব্লাড প্রেশার কম কিন্তু হিমাটক্রিট বেশি (রক্তক্ষরণ থাকলেও) নরমাল স্যালাইন বা হাইপারটনিক স্যালাইন বা প্লাসমা এক্সপান্ডার দিতে হবে (কোনো মতেই ব্লাড নয়)। Typical ডেঙ্গুর এগুলোই চিকিৎসা এবং সাধারণ ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। প্রতীয়মান হচ্ছে এটিপিক্যাল কেসগুলো মৃত্যুর কারণ, আগে এগুলোকে ডেঙ্গুর উপসর্গ বলা হতো না, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর জন্য আনুষঙ্গিক অসুখগুলো যেমন কিডনি, হার্ট, ফুসফুসের অসুখকে দায়ী করা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর জন্য ব্রেইন (এনসেফালাইটিস)সহ অন্যান্য অঙ্গগুলোর অসুখ হয়। অনেক ক্ষেত্রেই (বিশেষ করে মাল্টি অরগান ফেইলর) ইনটেন্সিভ কেয়ারে চিকিৎসা লাগে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্লাটিলেটের দরকার নেই বললেই চলে। প্রথম থেকেই পানি পান করার জন্য শক সিন্ড্রমের মতো জটিলতাগুলো হয় না। সবাইকে ওয়ার্নিং সাইনগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, এটিপিক্যাল ডেঙ্গুর ধারণা রাখতে হবে।

প্রতিরোধ : মশা ঠেকানোই আসল কথা, গৃহপালিত এডিসকে যে কোনোভাবেই মারতে হবে। পাত্রে মশার লার্ভা যেন না বাড়ে সে জন্য যে কোনো পাত্রে ৫ দিনের বেশি পানি জমতে দেয়া যাবে না।

ভ্যাক্সিন : ডেঙ্গু ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হওয়ার পর ইন্দোনেশিয়াসহ ১০টা দেশে চালু আছে। শুধু খরচ নয়, চারটি স্ট্রেনের ভ্যাক্সিনের প্রায়োগিক জটিলতার জন্য সার্বজনীন করা যাচ্ছে না।

জ্বর হলে কী করবেন

* প্রথম চারদিন : প্যারাসিটামল দিয়ে জ্বর কমাতে হবে। ৬ ঘণ্টা পর পর ৫০০ মিগ্রা একটা করে ট্যাবলেট দিতে হবে। ১০২ এর নিচে তাপমাত্রা না নামলে আরও একটা দিতে হবে। পানি পান করলে গা ধুলে জ্বর যাবে। জ্বর ১০০ তে থাকলেই চলবে। ৯৯ করার দরকার নেই।

* পানি প্রচুর (৩+ লিটার) পান করতে হবে। বিশ্রাম নিতে হবে। খাওয়া-দাওয়া ঠিক রাখার চেষ্টা করতে হবে, জুস ইত্যাদিতে ক্যালরি পাওয়া যাবে।

* ৪ দিনের বেশি হলে, অন্য উপসর্গ থাকলে ডাক্তার দেখাতে হবে।

* ভাইরাল ফিভার ৭ দিনের বেশি থাকে না।

* বিশ্রাম জ্বরের সময় ও জ্বর পরবর্তী ভোগান্তি কমায়।

* ৭ দিনের বেশি জ্বর থাকলে আমাদের দেশে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, রিকেটশিয়া ভাবা উচিত। টাইফয়েড তিন সপ্তাহের বেশি থাকে না। তিন সপ্তাহের বেশি হলে কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া ভাবতে হবে। ম্যালেরিয়ার টিপিক্যাল উপসর্গ পাওয়া যাবে এ সময়। আমাদের দেশে কালাজ্বর কমে গেছে।

* তিন সপ্তাহের বেশি হলে জ্বরকে পাইরেক্সিয়া অব আননোন অরিজিন (সংক্ষেপে পিইউও) বলে। এদের ক্ষেত্রে ২-৩ বার আউটডোরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এমন কি হাসপাতালে রেখে জ্বরের কারণ উদ্ঘাটন করা দরকার।

চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গুর মতো এডিস মশাবাহিত ভাইরাল ইনফেকশন

জ্বরের সঙ্গে গিরার ব্যথা মূল উপসর্গ। এতে র‌্যাশ থাকে, ব্লিডিং হয় না, শকে যায় না এবং রোগী মারা যায় না। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সম্পর্ক বলে মে থেকেই শুরু হয় জুলাই-আগস্টে সবচেয়ে বেশি হয়।

ব্যথা : সব গিরায়ই ব্যথা হতে পারে তবে পা-হাতে বেশি হয়। গিরা নাও ফুলতে পারে তবে ব্যথা (আর্থালজিয়া) মারাত্মক। চিকুনগুনিয়া শব্দের অর্থ বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো (stooped)। ঘাড়, পিঠের ও কোমরের মেরুদণ্ডে অনেক ব্যথা হয়। নামাজ পড়তে, সিঁড়ি ভাঙতে মনে হবে গিড়া যেন মচমচ করে ভেঙে যাচ্ছে। বিছানা শুয়ে পাশ ফিরতে, টয়লেট করতে চরম ব্যথা। ব্যথা তিন সপ্তাহের মধ্যেই সারে, অনেকের তিন মাসের বেশি লাগে। সব ব্যথা সম্পূর্ণ সেরে যায়। ডেঙ্গুতে মাজায় ব্যথা হতে পারে, মাসল পেইন, বোন পেইন হলেও গিরায় এত সিরিয়াস ব্যথা হয় না।

র‌্যাশ : ম্যাকুলোপ্যাপুলার, ডেঙ্গুর মতো কনফ্লুয়েন্ট পেটিকিয়াল (রক্তক্ষরণ) নয়। ৫ দিনের পরে বেরোয়। বাচ্চাদের, বয়স্ক রোগী ও অন্য অসুখে অসুস্থদের উপসর্গ মারাত্মক হতে পারে।

রক্তে প্লাটিলেট কমে না। সাতদিন পরে আইজিএম এন্টিবডি টেস্ট করে ডায়াগনোসিস কনফার্ম করা যেতে পারে। চিকিৎসার জন্য এটার দরকার নেই। ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া একই সঙ্গে হতে পারে, একটা আরেকটার জন্য প্রোটেকশন দেয় না। বিএসএমএমইউতে আইজিএম এন্টিবডি হয়। সরকারি বড় মেডিকেলে করা উচিত। গত বছরের মতো আউট ব্রেক হয়নি এবার। এবার ডেঙ্গু বেশি। প্রতিবছর একই রকম প্রাদুর্ভাবও হয় না (সাইক্লিক আউটব্রেক)। আমাদের চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু দুটারই ন্যাশনাল গাইড লাইন আছে।

চিকিৎসা : প্রথম সপ্তাহে জ্বরের চিকিৎসা ডেঙ্গুর মতোই-রেস্ট, ৩ লিটার পানি, ৩ গ্রাম প্যারাসিটামল (অন্য কোনো ওষুধ নয়)।

জ্বর চলে গেলে (এফেব্রাইল ফেস) : হেমরেজিক ডেঙ্গুতে সতর্ক থাকতে হয় কারণ এ ক্রিটিক্যাল সময়ে রোগী শকে যেতে পারে। চিকুনগুনিয়াতে এ বিপদ নেই। জ্বরের পরে ব্যথা অনেককে ভীষণ ভোগায়, এনএস এইড লাগে। করটিকোস্টেরয়েড, হাইড্রোক্সি ক্লোরকুইনোলিন কোন বিশেষ ফল দেয় না। রোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে যে যত ব্যথাই হোক সম্পূর্ণ সেরে যাবে, জয়েন্টের কোনো ক্ষতি হবে না।

প্রতিকার : মশা ঠেকাতে হবে। পাত্রে পানি ৫ দিনের বেশি জমাবেন না। পাত্র মশার বংশ বিস্তার হবে না। ঘরের মশা মারার জন্য যত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে, গৃহপালিত মশাকে না ঠেকালে হবে না।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)